ছবি এএফপি।
ঝিলমের বুকে ভেসেছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ।
‘সন্ধ্যারাগে ঝিলিমিলি ঝিলমের স্রোতখানি’ দেখে বাঁকা তলোয়ার মনে হয়েছিল তাঁর।
তার পর নৈঃশব্দ্য চিরে হংস বলাকার ডানার ঝটপট শুনেই সেই বহুচর্চিত কবিতার লাইন, ‘হেথা নয়, অন্য কোথা...অন্য কোনখানে!’ একেলে বাঙালি রবি ঠাকুর কতটা পড়ে কে জানে, ‘ভূস্বর্গে ভয়ঙ্করে’র মানেটা বোঝে হাড়ে হাড়েই! কাশ্মীরের সাম্প্রতিক খবরটার ধাক্কায় অন্তত তাই মনে হচ্ছে।
আ-হা, ভূস্বর্গে আপন বসতভিটে! হেঁশেলে কালোজিরে সর্ষে ফোড়নের গন্ধ! কুণ্ডু স্পেশালের কর্তামশাই সৌমিত্র কুণ্ডু হালকা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। ‘‘স্বপ্ন নয়। এটাই বাস্তব ছিল। ডালগেটে আমাদের লিজ নেওয়া রিজ হোটেল, ঝিলমে ভাসমান হোটেল কুণ্ডদের বলেই তো জানত সবাই।’’ কুণ্ডুদের সঙ্গে বাঙালির সপরিবার কাশ্মীর ভ্রমণ,
অমরনাথ যাত্রার শুরু ১৯৩৮এ। তাঁর প্রশ্ন, ‘‘আইনে হবেটা কী? কাশ্মীরে জমি কেনার সুযোগ করে দিলেই কি সেই বিশ্বাস, ভালবাসার দিন ফিরবে?’’ ১৯৭৮এ শ্রীনগরে বাংলার সন্তোষ ট্রফি জয়, এই তো সে-দিন মনে হয়, ক্যাপ্টেন গৌতম সরকারের। রিজের পাশে এমব্যাসি হোটেলের লিজধারী তখন ত্রিলোকেশ বন্দ্যোপাধ্যায়। ‘‘হোটেলের লনে প্র্যাকটিস করে মাছভাত খেয়ে মাঠে যাওয়া। আমরাই হোম টিম মনে হতো’’, বললেন গৌতম।
আরও পড়ুন: উত্তরপ্রদেশে দশ বছর ‘বন্দি’, বঙ্গে ফিরলেন শ্রমিক
ত্রিলোকেশবাবু ও শালের দোকানের রশিদসাহেবের তোড়জোড়ে বাদামবাগের দুর্গাপুজোও জমজমাট। অনর্গল বাংলায় সড়গড় নাজির আহমেদ ওরফে নান্নাজির মুদিখানায় অষ্টপ্রহর পোস্ত, পাঁচফোড়ন, হাঁসের ডিমের জোগান। ডাল লেক দেখতে দেখতে লাউ দিয়ে মাছের মুড়ো বা মুচমুচে তেকোণা নিমকি। কাশ্মীরে এমন সন্ধেও এসেছে! ১৯৮৯ পর্যন্ত এমনই ছিল কাশ্মীর, বলছিলেন কুণ্ডুদের প্রবীণ ম্যানেজার আশিস বিশ্বাস।
সে-যুগে বাঙালিকে লিজ দিতে পেলে বর্তে যেতেন বহু কাশ্মীরি হোটেলওয়ালাই। কুণ্ডুদের ১০০টার মধ্যে ৪৫টা সফর তখন উপত্যকায়। আশিসবাবু ছ’মাসই ভূস্বর্গবাসী। বললেন, ‘‘কাশ্মীরিয়তের মানে আমি বুঝি। কিন্তু মেহমানদারির মনটাই তো রাজনীতিতে শেষ করে দিচ্ছে।’’
সাবেক কলকাতার মার্বেল প্যালেসের হীরেন মল্লিকের আবার চোখে ভাসছে, ঠাকুরদার বাবা জ্ঞানেন্দ্র মল্লিকের লোকলস্কর নিয়ে কাশ্মীর-ভ্রমণের সব স্মারক। ইনলে করা হাতির দাঁত, আখরোট কাঠের বাক্স, ফিনফিনে মহার্ঘ্য শাল তো পারিবারিক সম্পদ। তবে তাঁর ধারণা, বাড়ি করে থাকতে হলে আজকের বাঙালির দৌড় শান্তিনিকেতন! ‘‘শিমূলতলা, মধুপুরে অপরূপ সব বাড়ির খণ্ডহর দেখলে চোখে জল আসে! বড় কর্পোরেটের আলাদা কথা! এত ঝক্কি মাথায় রেখে কাশ্মীরে কে যাবেন বলুন!’’
আরও পড়ুন: সম্পাদক-পুত্র ধৃত ইডি’র হাতে, বিড়ম্বনা সিপিএমে
ফেলুদাকেও অবশ্য শেষবেলায় ভূস্বর্গে রহস্যভেদে যেতে হয়েছিল। ‘‘তখনও কিন্তু তেমন গোলমাল ছিল না।’’ বললেন সত্যজিৎ রায়ের পুত্র সন্দীপ রায়। তবে বালক বয়সের সত্যজিৎও বেড়াতে গিয়ে ডাল লেক, হাউসবোটের ছবি তোলেন। বিলেতের ‘বয়েজ ওন’ পত্রিকা সে-ছবি ছাপিয়ে পুরস্কার দেয়।
এই পুজোতেও কাশ্মীর সফর সেরে আপ্লুত ভ্রমণার্থীরা। সোশ্যাল মিডিয়ায় ‘কাশ্মীর কি কলি’র সান্নিধ্য নিয়ে আলগা রসিকতা। বাঙালি ভ্রমণ সংস্থা, হোটেল চেন কর্তারা জল মাপারই পক্ষপাতী।
সৌমিত্রবাবুর প্রশ্ন, ‘‘ভূমিপুত্র ছাড়া জমি কেনায় নিষেধ তো অনেক রাজ্যে। উপত্যকায় আইন পাল্টে সম্পর্ক আরও খারাপ হবে না তো!’’
কাশ্মীর নিয়ে বাঙালির মনে ধন্দও বলছে, ‘অন্য কোথা, অন্য কোনখানে!’