ইম্ফল বিমানবন্দরে নিহত জওয়ানদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিংহ। নিজস্ব চিত্র।
কারা চালিয়েছে হামলা? খোঁজার দরকার নেই। তারা নিজেরাই সগর্বে দায় স্বীকার করে বিবৃতি দিয়েছে। হামলায় জড়িত ছিল কোন কোন জঙ্গি?
তদন্ত নিষ্প্রয়োজন। হত্যালীলা চালানোর পরে আক্রমণকারী সদস্যদের গ্রুপ ফটোই প্রকাশ করে দিয়েছে জঙ্গিরা! ঠিক যেমন ২০১৫ সালে চান্ডেলে সেনা কনভয়ে হামলা চালিয়ে ১৮ জন জওয়ানকে হত্যার পরে গ্রুপ ফটো প্রকাশ করা হয়েছিল।
মণিপুরের চূড়াচাঁদপুরে, শনিবার সকালে আসাম রাইফেলসের কনভয়ে জঙ্গি হানা ও সপরিবার কর্নেল-সহ সাত জনের মৃত্যুর ঘটনায় ফের নিরাপত্তাবাহিনীর গোয়েন্দা ব্যর্থতা সামনে এল। নিখুঁত পরিকল্পনায় আক্রমণ চালিয়েছে প্রায় ৩০ জন সশস্ত্র জঙ্গি। তার আগে অবশ্যই চলেছে মহড়া, নজরদারি। তার কোনও আঁচই পায়নি আসাম রাইফেলস। সীমান্তের কাছাকাছি এলাকাগুলিতে দখল রাখতে নিয়মিত টহল চলে। তার পরেও ফাঁক খুঁজে নিয়ে যে ভাবে পাল্টা আঘাতের সুযোগটুকু না দিয়ে সাত জনকে হত্যা করে গেল জঙ্গিরা তার বিভাগীয় ময়নাতদন্ত চলবে। কিন্তু আসাম রাইফেলসের এক কর্নেলের সন্দেহ, স্থানীয় গ্রামবাসীদের সক্রিয় সহযোগিতা ছাড়া এই ঘটনা সম্ভবই নয়। সীমান্ত হোক বা গ্রামের ভিতরের গতিবিধি- জঙ্গি কার্যকলাপের গোপন তথ্য জানতে সেনা-আধাসেনার ভরসা এই গ্রামবাসীরাই। ওই কর্নেলের দাবি, “অতীতেও বহু বার দেখা গিয়েছে গ্রামের মানুষ ডাবল-এজেন্ট হয়ে কাজ করেছেন। এ ক্ষেত্রেও সম্ভবত সেটাই ঘটেছে। কর্নেলের যাতায়াতের পথ, সময়, কনভয়ের গাড়ির সংখ্যা সব ভাল মতো জেনেই হামলা চালায় জঙ্গিরা।”
মোট ১৯ জনের দলটা চারটি গাড়ির কনভয়ে আসছিল। দুটো বোলেরোর মধ্যে কালো বোলেরোর সামনে লাল রঙে কমান্ডান্ট লেখাই ছিল। তাই কর্নেলের গাড়ি চিনতে কোনও অসুবিধেই হয়নি। চারদিক থেকে গুলিতে ঝাঁঝরা করা হয় সেটি। ছুটে আসা আরপিজিতে পোড়ে মিনি ট্রাক। গুলিতে আগেই মারা যান পাইলট কারের মেশিনগানধারী।
জঙ্গি হানার ঘটনায় এখন আতঙ্কে রয়েছেন আশপাশের গ্রামের মানুষ। বিপ্লব তাঁদের সঙ্গে মিশতে ভালবাসতেন। অনেক জঙ্গিকে মূল স্রোতে এনেছেন তিনি। বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের ব্যবস্থা করেছিলেন। গ্রামবাসীদের ভরসা করেছিলেন অনেকটাই। সেই ভরসাতেই হয়তো পরিবারকে নিয়ে বেরিয়েছিলেন ফরোয়ার্ড পোস্ট টহলে। কিন্তু সপরিবার কর্নেলের মৃত্যুর পরে সেনা যে প্রত্যাঘাত হানবেই তা নিশ্চিত। আর হানাদারদের সাহায্য করার সন্দেহে গ্রামেও ধরপাকড় চলার সম্ভাবনা। ইতিমধ্যেই দুই গ্রামবাসীকে জেরার জন্য ধরা হয়েছিল।
অসম, নাগাল্যান্ডের জঙ্গিদের প্রায় সকলকেই শান্তি আলোচনা ও সংঘর্ষবিরতির পথে আনতে সফল কেন্দ্র। মণিপুরে সেই কাজ আংশিক সফল কুকি ও জোমি জঙ্গিদের ক্ষেত্রে। কিন্তু মেইতেই জঙ্গিদের অধিকাংশই এখনও ‘সশস্ত্র বিদ্রোহ’ চালাচ্ছে। তাদের মধ্যে পিএলএ-র শক্তি সবচেয়ে বেশি। কিন্তু এ বারের আক্রমণে সঙ্গী হওয়া মণিপুরি নাগা পিপলস ফ্রন্টের নাম প্রায় কবর খুঁড়ে তুলে আনা।
সাধারণত মণিপুরের পার্বত্য এলাকায় টাংখুল নাগা তথা এনএসসিএন আইএমের আধিপত্য। কিন্তু টাংখুল বিরোধী নাগাদের দুই সংগঠন মণিপুর নাগা রেভেলিউশনারি ফ্রন্ট ও ইউনাইটেড নাগা পিপলস কাউন্সিল ২০১৩ সালে হাত মিলিয়ে এমপিএনএফ তৈরি করে। এত দিন পরে হঠাৎ এত বড় আক্রমণে তাদের হাত মেলানোটাও প্রশ্ন তুলছে।
আজ ইম্ফল বিমানবন্দরে নিহত জওয়ানদের শেষ শ্রদ্ধা জানানোর পরে মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিংহ বলেন, “সন্ত্রাসের সামনে রাজ্য সরকার কোনও ভাবেই আপস করবে না। যৌথ বাহিনী অভিযান শুরু করেছে। মণিপুরের সঙ্গে মায়ানমারের অরক্ষিত সীমান্তে বেড়া বসানোর কাজ চলছে। কিছু এলাকা বিতর্কিত হওয়ায় বেড়া বসানো যায়নি।”
চান্ডেলের হামলার জবাবে মায়ানমারের ভিতরে ঢুকে সার্জিকাল স্ট্রাইক করেছিলেন সেনার প্যারা কম্যান্ডোরা। সেনার এক লেফটেন্যান্ট জেনারেল জানান, শনিবারের ঘটনায় যে ভাবে নিরাপত্তাবাহিনীর মুখ পুড়েছে ও বাহিনীর ভিতরে রোষ বেড়েছে— তাতে ফের সার্জিকাল স্ট্রাইকের সম্ভাবনা অবশ্যই রয়েছে। জঙ্গিদের দলটা সীমান্তের ও পারে বেশি দূরে যায়নি। তাই দ্রুত হামলা চালালে সাফল্য মিলতে পারে।