বন্দুক উঁচিয়ে অভিযুক্ত, পিছনে হাত গুটিয়ে পুলিশ। ছবি: রয়টার্স।
নির্বাচনী প্রচারে গিয়ে নাম না করেই শাহিন বাগের সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন (সিএএ) বিরোধী আন্দোলনকে নিশানা করেছিলেন বিজেপি সাংসদ অনুরাগ ঠাকুর। বলেছিলেন, ‘‘দেশের বিশ্বাসঘাতকদের গুলি করে মারা উচিত।’’ অনুরাগের সেই বক্তৃতার পর একসপ্তাহও কাটেনি। এ বার তা করে দেখালেন ১৯ বছরের ‘রামভক্ত গোপাল’। দিল্লির জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে সিএএ বিরোধী মিছিলে পিস্তল হাতে চড়াও হলেন তিনি। ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগান দিয়ে আন্দোলনকারীদের উদ্দেশে গুলিও ছুড়লেন। আর তাঁকে বাধা দেওয়া তো দূর, বরং চোখের সামনে সব কিছু দেখেও কার্যত নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করল দিল্লি পুলিশ।
বৃহস্পতিবার মহাত্মা গাঁধীর ৭২তম মৃত্যুবার্ষিকীতে সিএএ বিরোধী মিছিল নিয়ে রাজঘাটের দিকে এগোচ্ছিল জামিয়া পড়ুয়া এবং সাধারণ মানুষের একটি দল। তার জন্য আগে থেকেই ওই এলাকায় বিশাল পুলিশ মোতায়েন ছিল। মিছিল আটকাতে হোলি ফ্যামিলি হাসপাতালের সামনে বসানো হয়েছিল ব্যারিকেডও। এগোতে না পেরে ব্যারিকেডের সামনেই রাস্তায় বসে পড়েন আন্দোলনকারীরা। সেইসময়ই তাঁদের উপর চড়াও হন গোপাল নামের ওই যুবক। প্রত্যক্ষদর্শীদের দাবি, পিস্তল উঁচিয়ে আন্দোলনকারীদের শাসান তিনি। বলেন, ‘‘কিসকো আজাদি চাহিয়ে? ম্যায় দুঙ্গা আজাদি। ইয়ে লো আজাদি।’’তার পরেই ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগান দিয়ে আন্দোলনকারীদের দিকে গুলি ছোড়েন।
অভিযুক্তের ছোড়া গুলিতে শাদাব ফারুখ নামের জামিয়ার এক পড়ুয়া আহত হয়েছেন। তাঁর হাতে গুলি লাগে। তিনি আদতে জম্মু-কাশ্মীরের বাসিন্দা বলে জানা গিয়েছে। হামলার পর প্রথমে হোলি ফ্যামিলি হাসপাতালেই নিয়ে যাওয়া হয় তাঁকে। পরে অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অব মেডিক্যাল সায়েন্স (এমস)-এর ট্রমা সেন্টারে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। দক্ষিণ-পূর্ব দিল্লির ডিসিপি চিন্ময় বিসওয়াল বলেন, ‘‘শাদাবের বাঁ হাতে গুলি লেগেছে। চিকিৎসকের জানিয়েছেন, উনি বিপন্মুক্ত। অভিযুক্তকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।’’
পিস্তল হাতে অভিযুক্তের এই ভিডিয়ো সামনে এসেছে।
আক্রান্ত পড়ুয়া। ছবি: পিটিআই।
আন্দোলনকারীদের মোবাইলে তোলা গোটা ঘটনার একটি ভিডিয়ো ইতিমধ্যেই সামনে এসেছে। তাতে দেখা গিয়েছে, ব্যারিকেডের উল্টো দিকে পুলিশের জমায়েত রয়েছে। তাদের সামনেই পিস্তল হাতে রাস্তার উপর দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন অভিযুক্ত গোপাল। এই ঘটনায় দিল্লির পুলিশের নিষ্ক্রিয়তাকেই দায়ী করেছেন আন্দোলনকারীরা। তাঁদের অভিযোগ, পুলিশ মোতায়েন থাকা সত্ত্বেও পিস্তল হাতে মিছিলের সামনে চলে আসেন অভিযুক্ত। অথচ তাঁকে আটকাতে এগিয়ে আসেনি পুলিশ। অভিযুক্ত গুলি চালানোর পর আন্দোলনকারীরাই তাঁকে ধরে ফেলে। তার পরে তাঁকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
তবে রীতিমতো আটঘাট বেঁধেই অভিযুক্ত আজকের মিছিলে হামলা চালাতে এসেছিলেন বলে জানা গিয়েছে। ‘রামভক্ত গোপাল’ নামে ফেসবুকে একটি অ্যাকাউন্ট রয়েছে তাঁর। তাতে শাহিন বাগের আন্দোলনকে শেষ করার একাধিক হুমকি দিয়েছেন তিনি। হামলার আগে এ দিন ওই অ্যাকাউন্ট থেকে লাইভও করেন তিনি। এই ঘটনায় ইতিমধ্যেই রাজনৈতিক তরজা শুরু হয়ে গিয়েছে। উস্কানিমূলক মন্তব্য করার জন্য বিজেপি সাংসদ অনুরাগ ঠাকুরের গ্রেফতারির দাবি তুলেছেন সিপিআই নেতা ডি রাজা। তাঁর দাবি, ‘‘দিল্লিতে নির্বাচনী প্রচারের সময় উস্কানিমূলক মন্তব্য করেছিলেন অনুরাগ ঠাকুর। তার ফলেই এই হামলা হয়েছে। বিশ্বাসঘাতকদের গুলি করে মারা মন্তব্যের জন্য অবিলম্বে তাঁকে গ্রেফতার করা উচিত।’’
এ দিনের ঘটনার জন্য দিল্লি পুলিশকে এক হাত নেন অল ইন্ডিয়া মজলিস-ই-ইত্তেহাদুল মুসলিমিন নেতা আসাদউদ্দিন ওয়েইসিও। টুইটারে তিনি লেখেন, ‘‘গত মাসে জামিয়ায় গিয়ে তো বেশ সাহস দেখিয়েছিলেন, আজ কী হল? নীরব দর্শক হওয়ার জন্য যদি কোনও পুরস্কার থাকত, তাহে প্রতিবার আপনারাই তা জিততেন। গুলিবিদ্ধ অবস্থায় ওই পড়ুয়াকে ব্যারিকেড টপকাতে হল কেন, এর কোনও জবাব কি আপনাদের কাছে আছে? কর্তব্য পালন করতে গিয়ে কি মনুষ্যত্ব হারিয়েছেন আপনারা?’’
ওয়েইসির টুইট।
ওয়েইসি আরও বলেন, ‘‘গডসের হাতে গাঁধী নিধনের দিনেই এই ঘটনা ঘটল। এই ধরনের কাপুরুষোচিত হামলা চালিয়ে আমাদের ভয় দেখানো যাবে না। আন্দোলন চলবে। এটা এখন গডসে বনাম গাঁধী, অম্বেডকর এবং নেহরুর ভারত হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে কোনও একটি পক্ষে বেছে নিতে হবে।’’
দিল্লি পুলিশের নিষ্ক্রিয়তার জন্য আবার সরাসরি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহকে দুষেছে আম আদমি পার্টি। শাহের ইস্তফার দাবি তুলেছে তারা। দলের সাংসদ সঞ্জয় সিংহ বলেন, ‘‘পুলিশি নিরাপত্তা সত্ত্বেও এমন ঘটনা ঘটল। আসলে দিল্লি পুলিশের হাত বেঁধে রেখেছেন অমিত শাহ। নইলে ঘটনাস্থলে কোনও না কোনও পদক্ষেপ করাই যেত।’’ দাঙ্গা বাধিয়ে দিল্লির নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়াই অমিত শাহের উদ্দেশ্য বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
হামলার পরেই এ দিন দিল্লিতে সাংবাদিক বৈঠক করেন কংগ্রেস নেতা মণীশ তিওয়ারি। তিনি বলেন, ‘‘দুর্ভাগ্যের বিষয় হল, যে হিংসা গাঁধীকে খুন করেছে, সেই হিংসাই আজ দেশ শাসন করছে। নির্বাচনী প্রচারে গিয়ে বিজেপি নেতারা যে মন্তব্য করেছেন, তা-ই এই হিংসায় উস্কানি জুগিয়েছে। আসলে মেরুকরণের চেষ্টা চলছে। ক্ষমতার অপব্যবহার করছে শাসক দল।’’