ঢাকা বিমানবন্দরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে স্বাগত জানাচ্ছেন বাংলাদেশের বিদেশ প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম। পাশে ভারতের হাই কমিশনার পঙ্কজ সারন। শুক্রবার রাতে বাপি রায়চৌধুরীর তোলা ছবি।
বিমান ছাড়ার আগে পাইলট একটি চিরকুট নিয়ে হাজির মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে। মুখে স্মিত হাসি। চিরকুটটিতে চোখ বুলিয়ে মুখ্যমন্ত্রীও দৃশ্যত খুশি। বললেন, ‘বাহ!’
এয়ার ইন্ডিয়ার কলকাতা-ঢাকা রুটের এ দিনের নিয়মিত উড়ানটির জন্য ‘ভিআইপি’ মর্যাদা ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ সরকার। বিশেষ নিরাপত্তায় ওড়ার জন্য আজ সন্ধ্যায় এটির ধারে কাছে আর কোনও বিমানকে ওড়ার অনুমতি দেওয়া হবে না। বিমানটি ঢাকায় নামার সময়েও অন্য কোনও বিমান ওঠানামা করতে পারবে না। সেই বার্তাই লেখা পাইলটের হাতের ওই চিরকুটটিতে।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ঢাকা পৌঁছবেন কাল সকালে। তার আগের রাতের এই নিয়মিত উড়ানেই ঢাকা পৌঁছলেন মমতা। শুধু কি আকাশের নিরাপত্তা? বিমানটি ঢাকা বিমানবন্দরের টারম্যাক ছোঁয়ার পরও ভিআইপি মর্যাদা পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর জন্য। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সামরিক উপদেষ্টা নিজে নিরাপত্তার তদারকিতে। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে বিদেশ প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম স্বাগত জানালেন মমতাকে। মমতা হেসে তাঁকে বললেন, ‘‘কেমন আছেন!’’ আসলে কয়েক মাস আগে মমতার ঢাকা সফরের সময়েও শেখ হাসিনার পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু এই শাহরিয়ার আলম আগাগোড়া মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গী ছিলেন। সুদর্শন এই তরুণ মন্ত্রীও পাল্টা কুশল বিনিময় করলেন তাঁর সঙ্গে। ছিলেন ঢাকায় ভারতের হাই কমিশনার পঙ্কজ সারনও। কলকাতা থেকে মমতার সঙ্গে গিয়েছেন মুখ্যসচিব সঞ্জয় মিত্র, পরিবহণ সচিব আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায় এবং কলকাতায় বাংলাদেশের ডেপুটি হাই কমিশনার জকি আহাদও। মমতা বিমানবন্দরের ভিআইপি লাউঞ্জে বসার পরে এল শেখ হাসিনার ফোন। সেই ফোনে বাংলাদেশের মাটিতে স্বাগত জানানোর পাশাপাশি সনির্বন্ধ অনুরোধ— থাকতে হবে অন্তত আর একটা দিন। কালই ফিরে যাওয়া চলবে না! মমতা তাঁকে বললেন, ‘‘ভেবে দেখি! আসলে কলকাতায় অনেক কাজ পড়ে রয়েছে তো।’’ হাসিনা আজ রাতেই মমতাকে নিজের বাসভবনে আসার আমন্ত্রণ জানান। মমতা হেসে বলেন— কালই দেখা হবে।
কিছু ক্ষণ পরে সরকারি গাড়ির কনভয়ে মমতা চললেন তাঁর হোটেলে। তিনি থাকছেন র্যাডিসন ব্লু গার্ডেনে, মোদী প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও হোটেলে।
স্থলসীমান্ত চুক্তি স্বাক্ষর তো উপলক্ষ মাত্র। নরেন্দ্র মোদী, শেখ হাসিনা এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়— আগামিকাল এই তিন চরিত্রের এক অভূতপূর্ব সমাপতনের সাক্ষী হতে চলেছে ঢাকা। কিন্তু মোদীর এই প্রথম ঢাকা সফরের সব চেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা হল, এখানে তাঁর সফরসঙ্গী হিসেবে থাকছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
মমতার ঢাকা সফর নিশ্চিত করতে কমপক্ষে ছ’মাস ধরে প্রস্তুতি নিয়েছেন মোদী। অসম, মেঘালয়, ত্রিপুরা-সহ উত্তর পূর্বাঞ্চলের কোনও মুখ্যমন্ত্রীকে এ বার তাঁর সঙ্গে ঢাকা সফরের আমন্ত্রণ জানাননি তিনি। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ নিজে মমতার কাছে আমন্ত্রণপত্র পাঠিয়েছেন। কূটনৈতিক সূত্রে খবর, কাল ঢাকা পৌঁছে বাংলাদেশের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনায় বসার আগে মমতার সঙ্গে একান্তে কথাবার্তা সেরে নিতে চান মোদী।
ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ককে দ্রুত এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য আজ মমতাকে কেন এত প্রয়োজন মোদীর? শ্রীলঙ্কা সম্পর্কে ভারতের বিদেশ নীতি রূপায়ণের জন্য জয়ললিতাকে তো এতখানি প্রয়োজন হয় না মোদীর!
মমতাকে স্বাগত জানাতে কেন এত উৎসাহের ঢল ঢাকায়? ঢাকার এক কূটনীতিক বিষয়টি বুঝিয়ে বললেন। তাঁর কথায়, মোদীর পাশে কাল মমতার থাকাটাই এক গুরুত্বপর্ণ কূটনীতির বার্তা। কারণ ইতিমধ্যে খালেদা জিয়ার দল বিএনপি ঘোষণা করেছে, যদি এ সফরে তিস্তা চুক্তি না হয়, তা হলে তারা আন্দোলনে নামবে।
তিস্তা চুক্তি বাস্তবায়িত না হওয়ার প্রধান প্রতিবন্ধক ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী— এমনটাই ধারণা ঢাকার। কিন্তু আজ মমতা যখন মোদীর সঙ্গে ঢাকায় এসেছেন, তখন অন্তত ঢাকার কাছে এই বার্তাটি মোদীও দিতে পারলেন যে, ভারতের অভ্যন্তরে কেন্দ্র বনাম রাজ্য সংঘাত এখন নিয়ন্ত্রণে।
আজ ঢাকা যাওয়ার প্রাক্কালে মমতা একটি প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, তিনি তিস্তা চুক্তির সম্ভাবনার বিরুদ্ধে নন। ভারত-বাংলাদেশ সুসম্পর্কের বিরুদ্ধেও নন। কিন্তু রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে পশ্চিমবঙ্গের স্বার্থ রক্ষা করাটা তাঁর প্রথম কাজ। উত্তরবঙ্গ যদি তিস্তা চুক্তির ফলে প্রয়োজনীয় জল থেকে বঞ্চিত হয়, তবে সেটা মানা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু আলোচনায় যদি এমন কোনও সূত্র বেরিয়ে আসে, যাতে বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ উভয়েই তাদের প্রয়োজনের জল পেতে পারে, তাতে তাঁর আপত্তির কোনও কারণ থাকতে পারে না।
বস্তুত শুখা মরসুমে তিস্তায় এখন কার্যত জল থাকে না। জলবিদ্যুতের জন্য সিকিমে ৮টি বাঁধ তৈরি করার ফলে জল প্রবাহ কমেছে, এমন অভিযোগ রাজ্যের। তিস্তা চুক্তি এই সফরে না হলেও মমতা কিন্তু তিস্তার জট ছাড়াতে আলোচনার বিরুদ্ধে নন। মমতা নিজেও ফেব্রুয়ারি মাসে এসে হাসিনার সঙ্গে বৈঠক করে গিয়েছেন, তাঁকে আশ্বাস দিয়েছেন সমস্যা সমাধানের।
একটা বিষয় স্পষ্ট যে, মমতাকে মোদী গত কয়েক মাস ধরে নানা স্তরে নানা বৈঠকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন যে বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানের গুরুত্ব অসীম। এক দিকে পাক-তালিবানি শক্তি বাংলাদেশের জমিকে ব্যবহার করে ভারতে সন্ত্রাসবাদ রফতানি করতে সচেষ্ট। অন্য দিকে, বন্দর থেকে সীমান্তবর্তী সড়ক— বাংলাদেশে নানা প্রকল্প গ্রহণ করে প্রভাব বাড়াতে সক্রিয় চিন। মোদী সরকার তাই বাংলাদেশে বঙ্গোপসাগরের উপকূলে একটি নতুন বন্দর নির্মাণের প্রস্তাব দিচ্ছে। ভেল-কে দিয়ে গড়ে তোলা হবে বৃহৎ বিদ্যুৎ প্রকল্প। মায়ানমার ও শ্রীলঙ্কাতেও চিন একই চেষ্টা চালাচ্ছে। এই পরিকাঠামোগত কাজে ভারতকে চিনের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামতে হচ্ছে। তাই নিরাপত্তার প্রশ্নে বাংলাদেশের সহযোগিতা যে আজ বিশেষ প্রয়োজন, সে কথা মোদী যেমন বোঝেন, বোঝেন মমতাও। আর বোঝেন বলেই রাজ্যে বিরোধীদের নানা তির্যক মন্তব্যের পরেও তাই অবশেষে তিনি ঢাকায় এসে পৌঁছলেন।