মালির আঁকা কার্টুন।
ওগো আমার নবীন শাখী, ছিলে তুমি কোন বিমানে?
সেই কবে গান বেঁধেছিলেন অতুলপ্রসাদ সেন। ভোটের দলবদলের হাওয়ায় হঠাৎ শুনলে কেউ অন্য রকম মানেও করতে পারেন! বেশ কয়েক বছর আগেই বিমান-সফর তার কৌলীন্য হারিয়েছে। কিন্তু বঙ্গজীবনে বিমান যে এমন সরগরম আলোচনার বস্তু হয়ে উঠবে, তা সত্যিই আঁচ করা যায়নি।
শনিবার চার্টার্ড বিমানে সওয়ার হয়ে রাজ্যের কতিপয় সদ্য প্রাক্তন মন্ত্রী, বিধায়ক, কাউন্সিলর দলবদল করতে যাওয়া ইস্তক জমজমাট নেটপাড়ার আড্ডা। কার্টুনিস্ট মালি তথা মাহফুজ় আলির ব্যঙ্গচিত্রেও আজকের ভারতের রূঢ় বাস্তবতা। দলে থেকে কাজ করতে না-পারা নেতাদের অন্য দলে টানতে এ দেশে জমকালো ব্যক্তিগত বিমানের আয়োজন রয়েছে। কিন্তু লকডাউনে ঘরে ফিরতে না-পারা অসহায় পরিযায়ী শ্রমিকদের অনেকের জন্য পথে মৃত্যুই ছিল ভবিতব্য। মালি-র কার্টুনের বিমানেও সুতো ধরে ঝুলন্ত শিশু সেই টাটকা স্মৃতিই উস্কে দিচ্ছে। একদা বিমানের ইকনমি ক্লাসের যাত্রীদের ‘ক্যাট্ল-ক্লাস’ বা গরুছাগলের দল বলে নিন্দিত হয়েছিলেন কংগ্রেসের তৎকালীন মন্ত্রী শশী তারুর। সদ্য বিজেপিভুক্ত নেতাদের নিয়ে হাসাহাসি চলছে, ক্যাট্ল-ক্লাস শব্দটি এ বার অন্য ব্যঞ্জনায় দেখা গেল।
এ দেশে সাধারণত তা-বড় শিল্পপতি কি বলিউডি চিত্রতারকাদের ব্যক্তিগত বিমান থাকে। ভোটের সময়ে বা কোনও প্রাকৃতিক দুর্যোগে উপদ্রুত এলাকায় নেতাদের বয়ে আনে বিশেষ বিমান। বরাবরই তা তীব্র শ্লেষে বিদ্ধ করেছে বাঙালি। ভোটপাখি হেলিকপ্টারকে নিয়ে কবীর সুমনের গান অনেকেরই শোনা। হেলিকপ্টার থেকে দূরবিনধারী নেতার দূর থেকে মানুষকে ভালবাসার ছবিটি তাতে স্পষ্ট। তারও বহু বছর আগে ইন্দিরা গাঁধীর প্রথম বারের প্রধানমন্ত্রিত্বের জমানায় এই নিয়ে কবিতা লেখেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।
‘‘প্রিয় ইন্দিরা তুমি বিমানের জানলায় বসে/ গুজরাটের বন্যা দেখতে যেও না/ এ বড় ভয়ঙ্কর খেলা...’’
সাম্প্রতিক কালে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বিমানে ঝটিকা-সফর নিয়েও রসিকতার অন্ত নেই। শোনা যায়, অর্থলগ্নি সংস্থার কেলেঙ্কারিতে ধৃত ব্যবসায়ী-সাংসদ কেডি সিংহও একদা তাঁর পুরনো দলের নেতাদের জন্য বিশেষ বিমানে ব্যক্তিগত সফরের ব্যবস্থা করতেন। রাজ্যের এক যুবনেতার কপ্টারে ভোটপ্রচারে কলকাতা থেকে সোনারপুর, বজবজ সফর নিয়েও রঙ্গব্যঙ্গ কম হয়নি। মনমোহন সিংহের জমানায় এক মন্ত্রীও দু’-এক হপ্তা অন্তর বিশেষ বিমানে দিল্লি থেকে তাঁর দেশের বাড়িতে যাতায়াত করতেন বলে শোনা গিয়েছে। জানা গিয়েছে, বিজেপির বিশেষ বিমানটি ধর্মেন্দ্র প্রধানকে কলকাতায় নামিয়ে দিল্লিতে ফেরার সময়েই তৃণমূলত্যাগী নেতাদের নিয়ে যায়। বিজেপির রাজ্যসভার সাংসদ স্বপন দাশগুপ্ত এই বিষয়টি নিয়ে আলোচনাতেই গররাজি। ‘‘লজিস্টিকস (যাতায়াতের ব্যবস্থাপনা বা খুঁটিনাটি) নিয়ে কথা বলতে পারব না!’’—বলছেন তিনি।
ইতিহাসের অধ্যাপক সব্যসাচী চট্টোপাধ্যায়ের মতে, ‘‘রাজনীতি বা ক্ষমতার হিসেবনিকেশের স্বার্থে বাংলার নেতাদের দিল্লি যাওয়া নতুন নয়। কিন্তু দল বদলের জন্য দিল্লিযাত্রাটা বেশ মজার!’’ আর অর্থনীতির প্রবীণ অধ্যাপক সৌরীন ভট্টাচার্যের কথায়, ‘‘দল বদলের রাজনীতির বাধ্যবাধকতা আরও গোদা ভাবে বোঝাতে বিশেষ বিমান একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতীক হয়ে উঠেছে।’’