হরিদ্বারে স্বামী আত্মবোধানন্দের পাশে ফয়জল খান। নিজস্ব চিত্র
হর-কী-পৌড়ীর ঘাটে ফয়জল খান লিফলেটগুলো যখন বিলি করছিলেন, গঙ্গা আরতি সবে শেষ হয়েছে। কিছু ক্ষণ আগেই ‘হর হর গঙ্গে’-র সঙ্গে গলা মিলিয়েছেন কয়েক হাজার মানুষ। কপালে চন্দনের টিপ পরা পুরোহিত-পাণ্ডাদের ভিড় গিজগিজ করছে।
সেই আবহে কালো জোব্বা ও সবুজ টুপির এক জন কৌতূহলের উদ্রেক তো করবেনই। হলও তাই। ইতিউতি কানাঘুষো শুরু হল। অত্যুৎসাহী কয়েক জন এগিয়ে এসে লিফলেটও নিলেন। তবে লিফলেটের থেকে তাঁদের অনেক বেশি কৌতূহল ফয়জলকে নিয়ে! ফয়জল অবশ্য নির্বিকার। তিনি এক নাগাড়ে হিন্দিতে বলে চলছিলেন, ‘‘গঙ্গা বাঁচান। গঙ্গাকে বাঁচাতেই হবে!’’
একটু থামলেন ফয়জল। দম নিতে। পাশে দাঁড়ানো যুবককে দেখিয়ে বললেন, ‘‘ইনি সাবির আহমেদ গাজি। সেই কাশ্মীর থেকে এসেছেন গঙ্গা নিয়ে প্রচারে। কেন্দ্রীয় সরকারকে এটা বুঝতে হবে যে, নমামি গঙ্গে পুরোপুরি ব্যর্থ!’’
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
কাশ্মীর থেকে হরিদ্বার? শুধু গঙ্গার টানে? কাশ্মীর তো নিজেই অশান্ত। পুলওয়ামা ক্ষত এখনও দগদগে! ছাব্বিশ বছর বয়সি সাবির বললেন, ‘‘কাশ্মীর তো আছেই! কিন্তু গঙ্গা সারা দেশের। গঙ্গা না-বাঁচলে এ দেশই থাকবে না।’’ কথায় কথায় সাবির জানালেন, গঙ্গার জন্য দিল্লিতে তিনি অনশনে বসেছিলেন। শুধু তিনি নন, অন্য রাজ্যের অনেকেই গঙ্গা দূষণ রোধে ও গঙ্গার অবিরল প্রবাহের জন্য অনশনে বসছেন নিয়ম করে। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকারের ‘হুঁশ নেই’! সরকার তো ‘নমামি গঙ্গে’ কতটা সফল, তা প্রচারে ব্যস্ত! তাই তাঁরা সকলে মিলে এক হয়েছেন হরিদ্বারে, আর এক জন অনশনকারীর সমর্থনে। —মাতৃ সদনের স্বামী আত্মবোধানন্দের পাশে দাঁড়াতে!
মাতৃ সদন! হরিদ্বারের এই আশ্রম এই মুহূর্তে দেশের গঙ্গা-আন্দোলনের ভরকেন্দ্র। এখানকার সন্ন্যাসীরা গঙ্গার অবিরল প্রবাহের জন্য লাগাতার অনশনে বসেছেন। প্রাণও হারিয়েছেন একাধিক জন। এই মুহূর্তে অনশনে স্বামী আত্মবোধানন্দ। টানা দেড়শো দিনের বেশি অনশনে রুগ্ণ, ভঙ্গুর তাঁর শরীর। হাঁটতেও পারছেন না ঠিক করে। কিন্তু চোখ দু’টো কী অসম্ভব উজ্জ্বল!
আমগাছের ছায়ায় চেয়ার পেতে বসেছিলেন আত্মবোধানন্দ। তাঁকে ঘিরে দাঁড়িয়ে-বসা ফয়জল, সাবির-সহ দেশ-বিদেশের অনেকে। ছাব্বিশ বছর ওই যুবকের পাশে দাঁড়িয়ে পঞ্চাশোর্ধ্ব ফয়জল বলছিলেন, ‘‘জানেন, আমাকে অনেকে জিজ্ঞেস করল, কেন আমি গঙ্গা নিয়ে এত কথা বলছি! কী করে তাঁদের বোঝাই, এটা ধর্মের বিষয় নয়। গঙ্গা সকলের!’’ আর স্বামী আত্মবোধানন্দ বলছিলেন, ‘‘ধর্মে-ধর্মে ভাগ করতে চাইছেন অনেকে। কিন্তু সেটা পারবেন না! কারণ, এটা আমার বা ফয়জলদের বিষয় নয়। এটা সকলের আওয়াজ!’’ একটানা কথাগুলো বলে হাঁফাচ্ছিলেন তিনি। তারপর বললেন, ‘‘গঙ্গোত্রীর পরে আর গঙ্গা খুঁজে পাবেন না। শুধু বাঁধ আর শিল্পের তরল বর্জ্য!’’
বর্জ্যে আটকে গঙ্গা। —নিজস্ব চিত্র
ঠিকই বলছিলেন আত্মবোধানন্দ। কারণ, হর-কী-পৌড়ীর গঙ্গা আরতির বৈভবের চার-পাঁচ কিলোমিটার দূরেই হরিদ্বারের যে গঙ্গা চোখে পড়বে, তার সঙ্গে গঙ্গার নির্মল বিজ্ঞাপনের মিলই নেই! সে জ্বালাপুরই হোক বা জাটওয়ারা পুলের এলাকা! জ্বালাপুরে একের পর এক নালা সরাসরি মিশছে গঙ্গায় আর তার ফলে নোংরা, আবর্জনায় গঙ্গার জলের রং কালো হয়ে গিয়েছে। আবার তেমন ভাবেই জাটওয়ারা পুলের দেড়শো মিটার দূরত্বে গঙ্গায় ভেসে উঠছে পশুর শব! কোথায় ‘নমামি গঙ্গে’! গঙ্গার নামে এক বৃহত্তর নালা বয়ে চলেছে যাবতীয় ক্লেদ, বর্জ্যের পাহাড় নিয়ে!
উত্তরাখণ্ড পয়জল নিগমের ‘কনস্ট্রাকশন অ্যান্ড মেনটেনেন্স ইউনিট গঙ্গা, হরিদ্বার’-এর প্রজেক্ট ম্যানেজার রাজীব কুমার জৈনের অবশ্য দাবি, ‘‘হরিদ্বারের মোট ২২টি নিকাশি নালা আগে গঙ্গায় পড়ত। ১৭টি আগে বন্ধ করা হয়েছিল। নমামি গঙ্গেতে আরও চারটি বন্ধ করা হয়েছে। বাকি একটি নালাও বন্ধের কাজ চলছে।’’
মাতৃ সদনের প্রধান স্বামী শিবানন্দ সে-সব দাবি উড়িয়ে বলছিলেন, ‘‘গঙ্গা নিয়ে সরকার যা দাবি করছে, সব মিথ্যা!’’ আত্মবোধানন্দের সঙ্গে দেখা করতে আসা রাষ্ট্রপুঞ্জের ‘পার্মানেন্ট ফোরাম অন ইনডিজেনাস ইস্যু’-এর এশিয়ার প্রতিনিধি ফুলমন চৌধুরীও বললেন, ‘‘পরিবেশের গুরুত্ব, গঙ্গার গুরুত্ব ভারত সরকারকে বুঝতে হবে।’’
সন্ধ্যার হর-কী-পৌড়ী ঘাটে দাঁড়ালে অবশ্য বোঝার উপায় নেই যে, গঙ্গা নিয়ে এত বিতর্ক, এত টানাপড়েন চলছে। কেউ গঙ্গার জল ভক্তিভরে মাথায় ছুঁচ্ছেন, কেউ প্রদীপ ভাসাচ্ছেন স্রোতে। কারও জুতো পরা পা যদি জলের কাছাকাছি চলে যায়, তাঁর বরাতে স্বেচ্ছাসেবকের বকুনি অবধারিত!—‘গঙ্গা মাঈয়া হ্যায়। জুতা হটাও ইধারসে!’
‘গঙ্গা মাঈয়া হ্যায়’!—ফয়জল, সাবিরেরা বলেন, গঙ্গা-আন্দোলনের সবথেকে বিপজ্জনক ও প্রতিবন্ধক শব্দবন্ধ এটিই! কারণ, গঙ্গা ‘মা’, এটা প্রচার করতে পারলে সরকার-প্রশাসনের চিন্তা নেই। ‘গঙ্গা-মা’-র আবেগে ঢাকা পড়ে যায় গঙ্গার দূষণ, গঙ্গাকে কেন্দ্র করে একের পর এক প্রকল্পের ব্যর্থতা! ফয়জল, আত্মবোধানন্দদের কাছেও গঙ্গা মা-ই। কিন্তু সেই মা-য়ের সঙ্গে রাজনৈতিক, প্রচারসর্বস্ব ‘গঙ্গা মাঈয়া’-র বিস্তর ফারাক। তাই তাঁরা চাইছেন, ‘মা’-র আসল চেহারা তুলে ধরতে! আর বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা তাঁদের আওয়াজ এক হচ্ছে দ্রুত।—ধর্ম, ভৌগোলিক গণ্ডি, ভাষা, প্রজন্মের ফারাক, সমস্ত কিছু মুছে দিয়ে! যেখানে-যেখানে ‘নমামি গঙ্গে’র বিজ্ঞাপন নেই, সেখানে।
গঙ্গার জন্য, গঙ্গার হয়ে!