শৌচালয়ে টাকা দিয়ে ভালবাসা কেনা যায় কি

রাজীবের মৃত্যুর পর তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু, অমেঠীর সাংসদ সতীশ শর্মা ওই মূর্তি বসিয়েছিলেন। সেখানেই বিজেপির স্থানীয় নেতা পঙ্কজ পাল প্রায় চ্যালেঞ্জ ছুড়ে বলেছিলেন, ‘‘চলে যান ওইসব গ্রামে। দেখবেন, গ্রামের ঘরে ঘরে মোদী সরকারের কাজের সুফল পৌঁছে গিয়েছে।’’

Advertisement

প্রেমাংশু চৌধুরী

অমেঠী শেষ আপডেট: ০৪ মে ২০১৯ ০৫:১০
Share:

রাজীব-মূর্তির সামনে। অমেঠীর রাস্তায়। নিজস্ব চিত্র

ঘরে এখনও সিমেন্ট, চুনকাম হয়নি। দাঁত বের করে থাকা ইটের দেওয়ালে বালগোপালের পাশেই ঝুলছে ইন্দিরা গাঁধীর ছবি। ‘রোজ ধূপধুনো দিয়ে ঠাকুরের মতোই পুজো করি’, গর্ব করে দেখান বাড়ির গিন্নি গায়ত্রী বর্মা।

Advertisement

অমেঠী শহর ছাড়িয়ে, মুরাই কা পুরয়া গ্রামের দুখহরণ মন্দিরের পাশ দিয়ে সাপের মতো এঁকেবেঁকে চলা সরু রাস্তা যেখানে শেষ, সেখানেই গায়ত্রীর বাড়ি। গ্রামের নাম দুর্গা মিশি পুরে। অমেঠীর জওহর নবোদয় বিদ্যালয়ে পড়তেন গায়ত্রী। এখনও মনে রয়েছে, ১৯৯১-এর ফেব্রুয়ারি মাসে স্কুলে এসেছিলেন রাজীব গাঁধী। প্রধান অতিথিকে মালা পরিয়ে বরণের দায়িত্ব পড়েছিল গায়ত্রীর কাঁধে। গায়ত্রী বলেন, ‘‘সেই শেষ। তার পরেই তো মে মাসে ওঁকে মেরে ফেলল জঙ্গিরা। ওই পরিবারের উপর আমাদের কেমন যেন টান তৈরি হয়েছে। মায়া পড়ে গিয়েছে।’’

কংগ্রেস নয়, গায়ত্রীদের গ্রামের খোঁজ মিলেছিল অমেঠীর বিজেপির নেতা-কর্মীদের কাছে। শহরে সরগড়া তিনমাথার মোড়ের মাথায় রাজীবের মূর্তি। রাজীবের মৃত্যুর পর তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু, অমেঠীর সাংসদ সতীশ শর্মা ওই মূর্তি বসিয়েছিলেন। সেখানেই বিজেপির স্থানীয় নেতা পঙ্কজ পাল প্রায় চ্যালেঞ্জ ছুড়ে বলেছিলেন, ‘‘চলে যান ওইসব গ্রামে। দেখবেন, গ্রামের ঘরে ঘরে মোদী সরকারের কাজের সুফল পৌঁছে গিয়েছে।’’

Advertisement

পৌঁছেছে অবশ্য। গায়ত্রীর ঘরের পিছনে গর্ত খোঁড়া হচ্ছে। ‘সান্ডাস’ তৈরি হবে। শৌচালয়। স্বচ্ছ ভারত অভিযান-এ ১২ হাজার টাকা মিলেছে। গ্রামের ঘরে ঘরে প্রধানমন্ত্রী উজ্জ্বলা যোজনায় রান্নার গ্যাস এসেছে। পাশের বাড়ির রামসুমের পালের অ্যাকাউন্টে দুই কিস্তিতে ৪ হাজার টাকা ঢুকেছে। প্রধানমন্ত্রী কিসান সম্মান নিধি-র টাকা। সৌভাগ্য প্রকল্পে নিখরচায় বিদ্যুৎ সংযোগ এসেছে গ্রামের দলিত বাড়িতে। সেই সঙ্গে বাড়ির দেওয়ালে নরেন্দ্র মোদীর ছবি-সহ বিজেপির পোস্টার। গায়ত্রীর দেওর মুম্বইতে কাজ করেন। ট্রেনের টিকিট নিয়ে ইদানিং চিন্তা করতে হয় না। ‘ওয়েটিং লিস্ট’-এ থাকলে পিএনআর নম্বর বিজেপির কোনও লোককে দিয়ে দিলেই হল। তাঁরা না কি দিল্লিতে ‘স্মৃতি ইরানির পিএ’-কে বলে দেন। অমেঠীর লোক হলেই টিকিট ‘কনফার্মড’ হয়ে যায়।

সত্যি? ‘একশো শতাংশ’ বলে বিজেপির নেতা ফের চ্যালেঞ্জ ছোড়েন, ‘‘কংগ্রেসের কেউ রাহুল গাঁধীর পিএ-র নাম বলে দেখাক। টিকিট কনফার্ম করানো তো দূরের কথা।’’ কিন্তু গায়ত্রী বলেন, ‘‘ওরা রান্নার গ্যাসই দিক আর সান্ডাসই বানাক। আমার গাঁধী পরিবারই পছন্দ।’’

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

মনে পড়ল, অমেঠী জেলায় ঢোকার মুখেই জইস-এ পেল্লায় রাজীব গাঁধী ইনস্টিটিউট অফ পেট্রোলিয়াম টেকনোলজি-র কথা। ৪৩১ কোটি টাকা খরচে তৈরি, ইউপিএ-সরকারের আমলের পরিকল্পনা। রাজীব গাঁধী অমেঠীর ফুরসতগঞ্জে ইন্দিরা গাঁধী রাষ্ট্রীয় উড়ান অ্যাকাডেমি তৈরি করেছিলেন। রাহুল সাংসদ হয়ে এই ইনস্টিটিউটের কাজ শুরু করেন। ফটকের উল্টো দিকে মহম্মদ নাদিমের ধাবা। ইনস্টিটিউটের ছাত্রদের ভিড়। নাদিম বলেন, ‘‘রাহুল গাঁধী কাজ শুরু করিয়েছিলেন। কিন্তু আড়াই বছর আগে স্মৃতি ইরানি এসে উদ্বোধন করলেন। রাহুলকে ডাকেওনি।’’

না। ডাকা হয়েছিল। ২০১৬-র অক্টোবরে ইনস্টিটিউটের উদ্বোধনে স্মৃতির সঙ্গে প্রকাশ জাভড়েকর, ধর্মেন্দ্র প্রধানও হাজির ছিলেন। শেষবেলায় স্থানীয় সাংসদ হিসেবে রাহুল গাঁধীর কাছে আমন্ত্রণপত্র পাঠানো হয়েছিল। রাহুল যাননি অনুষ্ঠানে। নাদিম বলেন, ‘‘এ সব করে কি সত্যি বদলানো যায়?’’

রাহুল গাঁধীর অমেঠী লোকসভা কেন্দ্রের কোলাজে টুকরো টুকরো এমনই ছবি। একদিকে গাঁধী পরিবারকে ঘিরে আবেগ। ইন্দিরা-রাজীব-সনিয়া হয়ে এখন রাহুল-প্রিয়ঙ্কার জন্য ভালবাসা। উল্টোদিকে সেই ভালবাসায় ভাগ বসিয়ে ‘জায়েন্ট কিলার’ হতে বদ্ধপরিকর স্মৃতি।

১৯৭৭-এ জনতা পার্টির জয় বাদ দিলে অমেঠী বরাবর কংগ্রেসের দখলে। ১৯৮০-তে সঞ্জয় গাঁধী সাংসদ হন। তাঁর পরে দশ বছর রাজীব গাঁধী। রাজীবের মৃত্যুর পর কংগ্রেসেরই সতীশ শর্মা, সঞ্জয় সিংহর পরে, সনিয়া গাঁধী পাঁচ বছরের জন্য সাংসদ ছিলেন। গত ১৫ বছর ধরে রাহুল অমেঠীর সাংসদ। কিন্তু গাঁধী পরিবারের গড় হলেও অমেঠী উত্তরপ্রদেশের আর পাঁচটা মামুলি শহরের মতোই। লোকসভা ভোটের ‘ভিভিআইপি কেন্দ্র’ হলেও চেহারার মলিন ছাপ কাটেনি। কেন? স্মৃতি সেই প্রশ্ন বারবার তুলছেন।

পাঁচ বছর আগে মোদী-ঝড়ে গোটা দেশের মতো অমেঠীতেও কংগ্রেসের ভোটব্যাঙ্কে ধস নেমেছিল। রাহুল গাঁধীর ভোট ৭১ শতাংশ থেকে ৪৬ শতাংশে নেমে এসেছিল। স্মৃতি ১ লক্ষ ৮ হাজার ভোটে হেরে যান। হাল ছাড়েননি তিনি। গত পাঁচ বছরে বারবার অমেঠী এসেছেন। কেন্দ্রে কিছু সময় শিক্ষামন্ত্রী থাকার সুবাদে কেন্দ্রীয় বিদ্যালয় তৈরির অনুমোদন দিয়েছেন। রেললাইন ডাবলিং-এর কাজ শুরু করিয়েছেন। কেন্দ্রের মোদী সরকার, উত্তরপ্রদেশের যোগী সরকার হাত উপুড় করে অমেঠীতে টাকা ঢালছে। সরকারি প্রকল্পের সুফল ঘরে পৌঁছে দিয়ে বিজেপি প্রচার করছে, গাঁধী পরিবার যা পারেনি, বিজেপি সেই উন্নয়নের কাজ করছে।

আর কংগ্রেস নেতারা বলছেন, উত্তরপ্রদেশে অন্য দলের সরকার থাকায় অমেঠীর কাজে বাধা পড়েছে। এখন ইউপিএ-আমলে শুরু করা কাজের ফিতে কেটে বাহবা কুড়োচ্ছে বিজেপি। ফুড পার্ক, কাগজ কলের মতো রাহুলের পরিকল্পিত প্রকল্প আটকে দেওয়া হচ্ছে। রাহুল নিজেই অমেঠীর ফুড পার্ক প্রকল্প বাতিল করার জন্য মোদী সরকারের দিকে আঙুল তুলেছেন।

কংগ্রেস সভাপতি গোটা দেশে প্রচারে ব্যস্ত। দাদার হয়ে প্রচারে ঝড় তুলছেন প্রিয়ঙ্কা গাঁধী বঢরা। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত অমেঠী ও রায়বরেলীতে ঘুরছেন। হাটেবাজারে গাড়ি থেকে নেমে চাষি, দোকানদার, বাড়ির মহিলাদের সঙ্গে কথা বলছেন। কোথায় কী সমস্যা, জানতে চাইছেন। জেনে নিচ্ছেন, তাঁকে বাদ দিয়ে কংগ্রেসের প্রচার কেমন হচ্ছে! অভিযোগ শুনলেই পাশের কংগ্রেস নেতাদের কড়া গলায় বলছেন, ‘প্রচার কো তেজ কিজিয়ে’।

৬ মে ভোট। বিজেপির দাবি, এবারও জোর টক্কর দেবেন স্মৃতি। আর স্মৃতির দাবি, জয়ের গ্যারান্টি নেই বুঝেই রাহুল কেরলেও প্রার্থী হয়েছেন।

কিন্তু ওই যে গাঁধী পরিবারের ‘মায়ার টান’! গায়ত্রী হাসেন, ‘‘সান্ডাসের টাকা দিয়ে ভালবাসা কেনা যায় না।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement