বছরে দু’কোটি চাকরি! কথা রেখেছে কি সরকার?

বেতন বাড়াও বললেই ছাঁটাই

হাতের তালুর মতো চেনেন পুরো এলাকা। গত কয়েক বছরে একের পর এক ঝাঁপ বন্ধ হয়ে যাওয়া কারখানার গল্প শোনাচ্ছিলেন তিনি।

Advertisement

ইন্দ্রজিৎ অধিকারী

শেষ আপডেট: ২৬ মার্চ ২০১৯ ০৩:৪৭
Share:

পেটে টান: ছাঁটাই এবং বেতন বৈষম্যের প্রতিবাদে মিছিল। নিজস্ব চিত্র

‘‘হাল বহুত খারাপ হ্যায়। হাম লোগ মর রহে হ্যায়। লেকিন মজদুরো কি মন কি বাত শুননেওয়ালা কোই নেহি।’’— গুরুগ্রামের শিল্পতালুকে চরকি পাক খেতে খেতে অন্তত বার চারেক বললেন রামনিবাস যাদব।

Advertisement

দীর্ঘদিন এই অঞ্চলে কাজ করছেন। হাতের তালুর মতো চেনেন পুরো এলাকা। গত কয়েক বছরে একের পর এক ঝাঁপ বন্ধ হয়ে যাওয়া কারখানার গল্প শোনাচ্ছিলেন তিনি।

পাশে জমে ওঠা ভিড়ও উগরে দিচ্ছে ক্ষোভ। কেউ কাজ না-পাওয়ার কথা বলছেন, তো কেউ কাজ যাওয়ার। আর যাঁরা কারখানার সাধারণ কর্মী, তাঁদের অভিযোগ, ‘‘যা পরিস্থিতি, তাতে এখন বেতন বাড়ানোর কথা বলতে গেলেই চাকরি খোয়ানোর আশঙ্কা!’’ এক দিকে মালিকেরা বলছেন, ব্যবসার হাল খারাপ। অন্য দিকে, দূরবীনেও দেখা নেই নতুন চাকরির। ফলে বেতন বৃদ্ধির কথায় ঢোঁক গিলছে কর্মী ইউনিয়নও।

Advertisement

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

গুরগ্রাম-মানেসর বলতেই এক ঝাঁক বড় গাড়ি সংস্থার নাম সবার আগে মনে আসে। হিরো মোটো কর্প, হোন্ডা ইত্যাদি। এ তল্লাটে তাই বহু লোক কাজ করেন অজস্র ছোট কারখানায়। বড় গাড়ি সংস্থাকে বিভিন্ন যন্ত্রাংশ সরবরাহ করে যারা। কর্মীদের অভিযোগ, ‘‘যেন ধীরে ধীরে শ্মশান হয়ে যাচ্ছে গুরুগ্রাম-মানেসর। নোটিস ছাড়াই হঠাৎ দুম করে কারখানার গেটে তালা ঝুলিয়ে দিচ্ছে একের পর এক যন্ত্রাংশ সংস্থা।’’

এমনই এক কর্মী দল সিংহ যাদবের কথায়, ‘‘নোটবন্দির পর থেকে এ পর্যন্ত গুরুগ্রামে পাকা ও ঠিকা কর্মী মিলিয়ে কাজ গিয়েছে প্রায় এক লক্ষ জনের।’’ কিন্তু নতুন চাকরি? প্রশ্ন শুনেই মুখ বাঁকালেন আর এক কর্মী দিক পাল সিংহ যাদব। উত্তর এল, ‘‘পুরনো কাজই থাকছে না, তো নতুন।’’ নরেশ কুমার কর গুনে গুনে বলছিলেন পাঁচ বছরে একের পর এক সংস্থার বিভিন্ন কারখানা চোখের সামনে বন্ধ হতে দেখার কথা। নোপিনো অটো (উদ্যোগ বিহার ক্যাম্পাস), অটো ডেকর, ওম্যাক্স অটো, ইন্ডোরেন্স, স্পিডোম্যাক্স, অটোম্যাক্স... তালিকা লম্বা।

কর্মীদের দাবি, এমনিতেই দেশে গত দেড় দশকে আইনকানুন ক্রমশ শ্রমিক-বিরোধী হয়েছে। তার উপরে মোদী সরকারের জমানায় প্রায় বন্ধই হয়ে গিয়েছে কর্মীদের অসুবিধার কথা শোনা। সঙ্গে কোপ নোটবন্দি, জিএসটির।

কূলদীপ সিংহ, পরশুরাম চন্দের মতো অনেকেরই মতে, নোটবন্দির পরে গুরুগ্রামে ব্যবসার পাট গুটিয়েছে বেশ কিছু ছোট সংস্থা। যাদের লেনদেনের বড় অংশ হত নগদে। নোট নাকচের ধাক্কা সামলে তারা ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। বহু ছোট সংস্থা আবার খাবি খাচ্ছে জিএসটির সঙ্গে তাল মেলাতে। তাঁদের কথায়, ‘‘যে কোনও মালিকের সঙ্গে কথা বলুন। প্রথমেই মাসের পর মাস জিএসটির টাকা আটকে থাকার কথা শুনবেন।’’

তবে শুধু নোটবন্দি-জিএসটির যুগলবন্দি নয়, আঙুল উঠছে শ্রম আইনের দিকেও। কুলদীপ যেমন বলছিলেন, ‘‘তিন বছর অন্তর যেই নতুন বেতন চুক্তির সময় আসে, সংস্থা বলে ব্যবসার হাল খারাপ! শুরু হয় ছাঁটাই। সবার আগে ছাঁটাই হন তুলনায় বেশি বেতনের কর্মীরা।

তার বদলে নেওয়া হয় ছ’মাসের ঠিকা কর্মী। যাঁদের বেতন সামান্য। সুযোগ-সুবিধা নেই বললেই চলে। সর্বত্র একই ছবি।’’

দিক পাল বলছিলেন, ‘‘অনেক সময় শুধু কর্মী ছাঁটাই করতেই কাজ না-থাকার অজুহাতে বন্ধ হয় কারখানা। কিন্তু আসলে কাজ সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় অন্যত্র। যেমন, একটি সংস্থা তাদের একটি কারখানায় তালা ঝুলিয়ে দিয়ে তার পুরো কাজ তুলে নিয়ে গিয়েছে অন্য একটি কারখানায়।’’ তাঁদের দাবি, এমন উদাহরণ ভূরি ভূরি। পরশুরামও বলছিলেন, ‘‘আকছার দেখবেন, যে সংস্থা কাজ নেই বলে এক কারখানার ঝাঁপ বন্ধ করছে, তারা বছর কয়েকের মধ্যে খুলে ফেলছে ৪-৫টি নতুন কারখানা। কাজ না থাকলে, নতুন কারখানা কেউ খোলে?’’

তাঁদের অভিযোগ, প্রথমত চাকরির বাজার এ ভাবে একেবারে বসে না গেলে, এতটা অন্যায় মুখ বুজে মানতে হত না কর্মীদের। তার উপরে এখন আইন এবং পরিস্থিতি এমন যে, কারও কাছে সমস্যা জানানোর জো নেই। নীরজ সিংহ বলছিলেন, ‘‘আগে কর্মী সংখ্যা ১০০ হলেই সেই কারখানায় তালা ঝোলানোর আগে সরকারি অনুমতি নিতে হত। এখন তা বাড়িয়ে ৩০০ করে দিচ্ছে কেন্দ্র। একেই তো নিয়মকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বহু শ্রমিককে কর্মী বলে স্বীকারই করা হয় না। এমন হলে তো সংস্থার পোয়াবারো!’’

ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব পাবলিক ফিনান্স অ্যান্ড পলিসির অর্থনীতির অধ্যাপক পিনাকী চক্রবর্তী বলেন, ‘‘কেউ চাকরি খোয়ালে তার জন্য বিমা, বেকার ভাতা ইত্যাদি মিলিয়ে সামাজিক সুরক্ষা জাল (সোশ্যাল সিকিউরিটি নেট) তৈরি এ জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। চাহিদামাফিক কর্মী নেওয়া ও ছেঁটে ফেলার সুবিধা শিল্প দাবি করে। কিন্তু তার প্রাথমিক শর্ত সুরক্ষা জাল। যা তৈরি করা সরকারের কাজ।’’ ফেরার আগে স্থানীয় কর্মী ইউনিয়নের নেতা অনিল পানওয়ার বলছিলেন, ‘‘মেক ইন ইন্ডিয়ায় অন্তত আমাদের চেনা কেউ চাকরি পাননি। যাঁদের কাজ গিয়েছে, ছাঁটাইয়ের সময়ে পাওয়া টাকায় ছ’মাসও চলেনি তাঁদের। মোদীজি বড়াই করে বেটি পড়াওয়ের কথা বলেন। লিখবেন, কাজ যাওয়ার পরে স্কুলের ফি দিতে না-পারায় অনেকের ঘরের বেটির স্কুল যাওয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছে।’’

(চলবে)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement