ছেলের ছবি হাতে সিনি সয়। ছবি: নিজস্ব চিত্র
তেরো বছর হয়ে গেল ছেলেটা চলে গিয়েছে।
তিনি জন আন্দোলনের পোড় খাওয়া নেত্রী। জমি বাঁচানোর লড়াইয়ে ছেলে হারিয়ে শোক করা তাঁর সাজে না। কিন্তু ২৫ বছরের তরতাজা ছেলেটা পুলিশের গুলি বুকে নিয়ে ‘জল, জল’ বলে চিৎকার করছে, তার পর হাত-পা ধরে তাকে ছুড়ে দেওয়া হল গাড়ির ভিতরে—এমন স্মৃতি বুকে নিয়ে কোন মা নিজেকে শান্ত রাখতে পারেন। চোয়াল শক্ত হয় সিনি সয়ের, গলা ধরে আসে।
২০০৬-এর ২ জানুয়ারি। টাটাদের ইস্পাত কারখানার জমিতে পাঁচিল দেওয়া নিয়ে গোলমালের জেরে কলিঙ্গনগরে গুলি চালাল পুলিশ। সব মিলিয়ে মারা গেলেন ১৩ জন। তাঁদের মধ্যে তিন জন মহিলা, এক জন নাবালক। প্রাক্তন বিচারপতি প্রদ্যুম্নকুমার মহান্তির রিপোর্ট বলছে, কাঁদানে গ্যাস, রাবার বুলেট ছুড়ে, শূন্যে গুলি চালিয়ে উন্মত্ত জনতাকে ঠেকানো যায়নি। তখন গুলি চালানোর আদেশ না দিয়ে কোনও উপায় ছিল না। ওই ঘটনার জন্য পুলিশ দায়ী নয়। মহান্তি কমিশনের রিপোর্ট গ্রহণ করেছে নবীন পট্টনায়কের সরকার।
কলিঙ্গনগরে কারখানা করার জন্য রাজ্য সরকার আদিবাসীদের কাছ থেকে জমি নিয়েছিল ১৯৯০-৯১ সালে। তার পর ১৫ বছর চুপচাপ। খাতায়কলমে জমি সরকারের হলেও আদিবাসীরা সেখানেই চাষআবাদ করেন। ২০০৫-এ ফের কারখানা গড়ার তোড়জোড় মাথাচাড়া দিল। আপত্তি জানালেন আদিবাসীরা। দাবি করলেন, বর্তমান বাজার দরে জমির দাম চোকাতে হবে। কেউ কেউ আবার জমি ছাড়তেই আপত্তি করলেন।
দু’একটি কোম্পানির সঙ্গে আলোচনার পরে শেষ পর্যন্ত ইস্পাত কারখানা গড়ার জন্য টাটাদের জমি দিতে মনস্থ করল ওড়িশা সরকার। জমিতে পাঁচিল তোলার তোড়জোড় শুরু হতেই গোলমাল তুঙ্গে।
কটকের কলেজ থেকে গ্র্যাজুয়েশন করলেও চাকরি করার কথা ভাবেননি ভগবান সয়। বলেছিলেন, পরের গোলামি করব না। কিন্তু মাথার উপরে বাবা নেই, সংসারটা তো চালাতে হবে। চাষবাসেই ছেলের মন দেখে ট্রাক্টর কিনে দিয়েছিলেন সিনি। তাঁদের সংসার তো চলতই, আরও চার-পাঁচটা দিনমজুরের সংসার প্রতিপালন হয়ে যেত।
“আগের দিন নতুন বছর। ছেলে বলল, একটু খাওয়াদাওয়া হোক। দু’টো ছাগল কাটা হল। কত লোক খেল।” বলছিলেন সিনি। পরের দিন সকালে খবর এল, জমিতে পাঁচিল তোলা নিয়ে চম্পাকুইলায় গোলমাল হয়েছে। পুলিশ লাঠি চালিয়েছে। বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদেরও রেয়াত করেনি বলে অভিযোগ। কোলের ছেলেকে ফেলে রেখে বাবা-মা পালিয়েছেন।
২০০৫ থেকেই জমি আন্দোলনের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে গিয়েছেন সিনি। বিস্থাপন বিরোধী জনমঞ্চের নেত্রী। চম্পাকুইলায় গোলমালের খবর পেয়েই ছুটলেন। “আমাদের দাবি ছিল, গ্রামসভার সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে হবে কোম্পানিকে। প্রশাসন শুনল না। গোলমাল তর্কাতর্কির মধ্যেই আচমকা মাটিতে পোঁতা ডিনামাইট ফাটল। পাঁচিল গড়ার জন্য ঠিকাদারেরাই পুঁতেছিল ডিনামাইট। আর তার
পরেই শুরু হল গুলি চালানো,” বললেন সিনি।
ঝাড়খণ্ড মাইনস এরিয়া কো-অর্ডিনেশন কমিটি এবং ঝাড়খণ্ডস কমিশন ফর হিউম্যান রাইটসের গড়া যৌথ তদন্ত কমিটির রিপোর্ট বলছে, সে দিনের ঘটনায় প্রথম ‘শহিদ’ ভগবান সয়। আর সিনি বলছেন, “আমি যখন বেরোই, ছেলেটা বাড়িতেই ছিল। তার পর কখন গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে! হঠাৎ শুনি সবাই বলছে, ভগবানের গুলি লেগেছে। ছুটে গেলাম। দেখি জল, জল বলে কাতরাচ্ছে। কিন্তু কাছে যেতে পারলাম না। পুলিশ এলোপাথাড়ি গুলি চালাচ্ছিল। তার পর চার জনে মিলে হাত-পা ধরে ওকে একটা
গাড়ির ভিতরে ছুড়ে দিল। তখনও বেঁচে ছিল ছেলেটা।”
রিপোর্ট বলছে, সে দিন ঘটনাস্থলেই মারা যান ৬ জন। বাকিরা হাসপাতালে। সিনিদের অভিযোগ, হাসপাতালের দরজা বন্ধ করে রেখে আহতদের ঢুকতে দেয়নি সরকার। তাঁদের রাস্তায় শুইয়ে শুরু হয় প্রতিবাদ। তবে দরজা খোলে। আহতদের উপরেও পুলিশ অত্যাচার করেছে বলে অভিযোগ। প্রশাসন যা মানেনি।
ক’দিন পরে দেহ এল ভগবানের। দু’টো হাত কব্জি থেকে কাটা। তাঁর মতো আরও পাঁচ জনেরও একই দশা। শোনা গেল, আঙুলের ছাপ মিলিয়ে শনাক্তকরণের জন্য হাত কেটে রাখা হয়েছিল ময়নাতদন্তের সময়। ফের তোলপাড়। নিন্দার ঝড় উঠল। এ বার অবশ্য সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকদের শাস্তি দিল সরকার।
ছেলেকে হারিয়েও থামেননি সিনি। গ্রামে গ্রামে ঘুরে সংগঠন করেছেন জমি দখলের বিরুদ্ধে। ‘মাওবাদী’ তকমা লেগেছে গায়ে। ২০১২-এ গ্রেফতার হয়েছেন। দেশদ্রোহের অভিযোগ এনেছে সরকার। দেড় বছর পরে তাঁকে বেকসুর ঘোষণা করেছে কটক হাইকোর্ট।
কিন্তু সভ্যতা এগিয়ে চলবে, এটাই তো সত্য। আর তার জন্য কিছু মানুষ উৎখাত হবেন, তা-ও যুগ যুগ ধরেই সত্য। সিনি বলছেন, তার বিরুদ্ধে মানুষ লড়াই করে চলবে, সত্য সেটাও। “উন্নয়ন আর শিল্পায়নের নামে সবাই আমাদের মতো আদিবাসীদের জমি দখল করে নিতে চায়। বলে বদলে পুনর্বাসন তো দিচ্ছি। পুনর্বাসন মানে তো দু’কামরার এক চিলতে ঘর, আর ঘিঞ্জি কলোনি। কেউ বুঝতে
চায় না, মাটি আর প্রকৃতির সঙ্গে আদিবাসীদের সংস্কৃতি কতটা ওতপ্রোত ভাবে জড়িত।”
কলিঙ্গনগরে টাটাদের কারখানা চালু হয়েছে। দ্বিতীয় পর্যায়ে কারখানা সম্প্রসারণের পরিকল্পনাও হচ্ছে। কিন্তু সিনি বলছেন, “আমি হার মানব না। যত দিন বাঁচি লড়াই চলবে। ছেলের কসম।”