সাধ্বী প্রজ্ঞা এখন স্বামী পূর্ণচেতনানন্দ

ভোপালের ‘পশ এরিয়া’ বলে পরিচিত রিভিয়েরা টাউনের এই বাড়ির দোতলায় আপাতত স্বামী পূর্ণচেতনানন্দ গিরির ‘অধিষ্ঠান’।

Advertisement

প্রেমাংশু চৌধুরী

ভোপাল শেষ আপডেট: ২৬ এপ্রিল ২০১৯ ০২:৩১
Share:

প্রচারে সাধ্বী প্রজ্ঞা। বৃহস্পতিবার ভোপালে। ছবি: পিটিআই।

এত জবা ফুল কী হবে?

Advertisement

ফুল পাড়তে পাড়তেই মাথায় ঘোমটা দেওয়া বয়স্ক মহিলা নিচু গলায় উত্তর দেন, ‘‘আচার্য মহামণ্ডলেশ্বর স্বামী পূর্ণচেতনানন্দ গিরিজি এখন পুজোয় বসবেন। তারই আয়োজন।’’

ভোপালের ‘পশ এরিয়া’ বলে পরিচিত রিভিয়েরা টাউনের এই বাড়ির দোতলায় আপাতত স্বামী পূর্ণচেতনানন্দ গিরির ‘অধিষ্ঠান’। সকাল থেকে বাড়ির সামনে বিজেপি-আরএসএস-বিশ্ব হিন্দু পরিষদের গলায় গেরুয়া চাদর, কপালে টিকা দেওয়া নেতা-কর্মীদের ভিড়। কারণ স্বামী পূর্ণচেতনানন্দই এ বার মধ্যপ্রদেশের রাজধানী শহর ভোপাল লোকসভা কেন্দ্রে বিজেপি প্রার্থী।

Advertisement

ভুল তথ্য নয়। যিনি মালেগাঁও বিস্ফোরণ কাণ্ডের অন্যতম অভিযুক্ত, জামিনে মুক্ত সন্ন্যাসিনী সাধ্বী প্রজ্ঞা, তিনিই স্বামী পূর্ণচেতনানন্দ গিরি। কিছু দিন আগেই প্রয়াগের কুম্ভের সময় ভারত ভক্তি আখাড়া-র আচার্য মহামণ্ডলেশ্বর ঘোষিত হয়েছেন। এককালে এবিভিপি-র নেত্রী প্রজ্ঞা সিংহ ঠাকুর থেকে সন্ন্যাস গ্রহণের পর সাধ্বী প্রজ্ঞা এখন নিজেকে আচার্য মহামণ্ডলেশ্বর স্বামী পূর্ণচেতনানন্দ গিরি হিসেবেই পরিচয় দিতে পছন্দ করেন।

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

নাম যা-ই হোক। ভোপালে সাধ্বীর জনপ্রিয়তায় খামতি নেই। তিনি ভক্তদের উপদেশ দেন, ‘গরুর লেজের দিক থেকে মাথার দিকে পিঠের শিড়দাঁড়া বরাবর হাত বোলালে উচ্চ রক্তচাপের রোগ সেরে যাবে।’ গরুর নয় অবশ্যই, মানুষের। আর গোবর, গোমূত্র, গোদুগ্ধ, গোঘৃত ও গোদধি মিলিয়ে তৈরি পঞ্চগব্য ক্যান্সারের অব্যর্থ ওষুধ বলেও দাবি করেন সাধ্বী প্রজ্ঞা। আয়ুর্বেদিক ডাক্তারের কন্যা প্রজ্ঞার দাবি, এটা বিজ্ঞানসম্মত। তাঁর স্তনের ক্যান্সার ওই পঞ্চগব্যতেই সেরে গিয়েছে।

কংগ্রেসের দিগ্বিজয় সিংহের বিরুদ্ধে বিজেপি ‘কট্টর হিন্দুত্ব’-র মুখ সাধ্বী প্রজ্ঞাকে প্রার্থী করেছে। আর তাঁকে ঘিরেই রাজা ভোজের প্রতিষ্ঠিত, বেগমদের শাসিত শহর ভোপালে এখন তীব্র মেরুকরণ। মধ্যপ্রদেশ বা ভোপালের উন্নয়ন, চাষির সমস্যা, চাকরির অভাব— এ সব প্রশ্নের নামগন্ধও নেই। বিতর্ক চলছে, কে হিন্দু আর হিন্দু নয়? কে রাষ্ট্রবাদী, কে নয়? সর্বোপরি, কে ধার্মিক আর কে ধার্মিক নয়? সাধ্বী প্রজ্ঞা নিজে বলছেন, ‘‘এটা ধর্ম আর অধর্মের লড়াই। আমি সেখানে নিমিত্তমাত্র।’’

একসময় এই ভোপালেই বিশ্ব হিন্দু পরিষদের দুর্গা বাহিনীর সক্রিয় সদস্য ছিলেন প্রজ্ঞা সিংহ ঠাকুর। গ্বালিয়রে কলেজে পড়ার সময় এবিভিপি-তে নাম লেখানো, তার পর ভোপালেই তৈরি করেন জয় বন্দেমাতরম জন কল্যাণ পরিষদ, রাষ্ট্রীয় জাগরণ মঞ্চ। বাইক চালিয়ে দাপিয়ে বেড়াতেন। অভিযোগ উঠেছিল, ২০০৮-এর মালেগাঁও বিস্ফোরণে প্রজ্ঞার সেই বাইক-ই ব্যবহার হয়েছিল।

ভোপালে গায়ত্রী মন্দিরে পুজো দেওয়ার ফাঁকে প্রজ্ঞার দাবি, ‘‘সবটাই ষড়যন্ত্র। গেরুয়া সন্ত্রাসবাদের মতো শব্দ অসহনীয়। এটা দেশের হিন্দু সংস্কৃতির বিড়ম্বনা। এর ন্যায় দরকার।’’ সেই ন্যায়ের জন্যই তাঁর দিগ্বিজয়ের বিরুদ্ধে লোকসভার লড়াইয়ে নামা বলে সাধ্বীর দাবি। কারণ দিগ্বিজয়ই গেরুয়া সন্ত্রাসবাদের অভিযোগ তুলেছিলেন। তাঁর যুক্তি, ‘‘আমি আধ্যাত্মিক জীবনে সুখীই ছিলাম। আমি সাধ্বী। আমার ঠাকুর আমার রাষ্ট্র, আমার গুরু। আমি সমর্পিত। কিন্তু দিগ্বিজয় সিংহ কী ভাবে হিন্দু হয়ে হিন্দু সন্ত্রাসবাদের কথা বলেছিলেন? হিন্দুরা সন্ত্রাসবাদী হতে পারে না। এ আমাদের সংস্কৃতিতেই নেই।’’

পঞ্চগব্যে ক্যান্সার সেরে গেলেও, হাঁটতে চলতে অসুবিধা হয় সাধ্বী প্রজ্ঞার। সিঁড়ি দিয়ে ওঠা-নামার সময় দু’পাশে দু’জনের কাঁধে ভর দিয়ে পা ফেলেন। সাধ্বী প্রজ্ঞার ভগ্নিপতি ভগবান ঝা বলেন, ‘‘মালেগাঁও বিস্ফোরণ কাণ্ডে গ্রেফতারের পর পুলিশের অত্যাচারের পর থেকেই এই অবস্থা। দীর্ঘদিন বিছানা বন্দি থাকতে হয়েছিল।’’ ভগবান মনে করিয়ে দেন, তিনি নিজেকে প্রজ্ঞার ভগ্নীপতি বলে পরিচয় দেন না। কারণ সন্ন্যাসিনীদের সন্ন্যাস গ্রহণের আগের জীবনের আত্মীয়দের সঙ্গে সম্পর্ক থাকে না।

১৯৮৯ থেকে ভোপাল বিজেপির দখলে। একসময় বিজেপির আরেক গেরুয়াধারী নেত্রী উমা ভারতী ভোপালের সাংসদ ছিলেন। কংগ্রেস নেতাদের অভিযোগ, নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহর কথা থেকে স্পষ্ট, ভোপালে সাধ্বী প্রজ্ঞাকে নামিয়ে বিজেপি মধ্যপ্রদেশ তথা গোটা দেশে ধর্মীয় মেরুকরণ করতে চাইছে। কিন্তু বিজেপি নেতাদের দাবি, ভোপালে প্রজ্ঞাই এগিয়ে।

অস্বস্তি শুধু একটিই। নরেন্দ্র মোদী সন্ত্রাস দমনে তাঁর সাফল্য দেখিয়ে ভোট তুলতে চাইছেন। এ দিকে মুম্বই সন্ত্রাসদমন বাহিনীর প্রাক্তন প্রধান হেমন্ত কারকারে তাঁর অভিশাপেই মারা গিয়েছেন বলে দাবি করে বসেছেন প্রজ্ঞা। বেকায়দায় পড়ে বিজেপি নেতৃত্ব এ সব নিয়ে মুখ না খোলার নির্দেশ দিয়েছে। ওই প্রশ্ন করলেই সাধ্বী মৌনব্রতে চলে যাচ্ছেন। না হলে বলছেন, ‘‘আজ পুজো দিয়েছি। ঈশ্বরের ভাবে রয়েছি। এ সব কথা থাক।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement