১৯৪৭ সালে প্রতিষ্ঠিত জামশেদপুরের বাংলা মাধ্যম স্কুল। যদিও বাংলা পাঠ্যপুস্তকের অভাবে পঠনপাঠন চলে হিন্দিতে। ছবি: পার্থ চক্রবর্তী
দ্রিম দ্রিম শব্দে বাজছে মাদল। মাদলের শব্দে এক অদ্ভুত মাদকতা ছড়িয়ে গালুডির মাতুলডিহ গ্রামের চারিদিকে। বাড়ির দাওয়ায় বসে ঝুমুর নাচের শিল্পীরা গাইছেন গান। গানের সঙ্গে পা মেলাচ্ছে মেয়েরা। এই নাচগান তাঁদের রুজি রোজগারের ভরসা। কিন্তু এই শিল্প ওরা আর কত দিন ধরে রাখতে পারবেন এই আশঙ্কা জমেছে তাঁদের মনে। গান থামিয়ে ঝুমুর শিল্পী মনোরঞ্জন মাহাতো বলেন, ‘‘ঝাড়খণ্ড তৈরি হওয়ার পরে ১৯ বছর কেটে গেল। কোনও রাজনৈতিক দলই কথা রাখেনি। তাঁদের শিল্প আজ শেষের পথে। তাঁদের লোক-কলা, সংস্কৃতি ধুঁকছে। ধুঁকছে বাংলা ভাষা। ছেলেমেয়েরা বাংলা পড়তে লিখতেই পারে না। ঝুমুর নয় ওরা হিন্দি গানই ভালবাসে।’’
গালুডির গ্রামই হোক বা জামশেদপুর শহর— বাংলা ভাষা, বাংলা লোকসংস্কৃতি যে কফিনে ঢুকে যেতে বসেছে, তা স্বীকার করে নিচ্ছেন অনেকেই। জামশেদপুরের বাঙালিরা জানাচ্ছেন, বিজেপির রঘুবর সরকার বাংলাকে দ্বিতীয় ভাষার স্বিকৃতি দিয়েছে ঠিকই, কিন্তু কোনও পরিকাঠামোই তৈরি করেনি। সরকারি স্কুলে কোনও বাংলা বই সরবরাহ করে না সরকার। বাংলা মাধ্যম স্কুলগুলি মৃত্যুপথযাত্রী।
বাংলা ভাষাকে শুধু নামমাত্র দ্বিতীয় ভাষায় স্বীকৃতি দেওয়া নয়, এই ভাষাকে ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট থেকে বাইরে বার করবই— এই প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে সব রাজনৈতিক দলই। শুধু বিজেপি বা ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চাই নয়, জামশেদপুর লোকসভা কেন্দ্রে এ বার তৃণমূলও প্রার্থী দিয়েছে। জামশেদপুরে তাদের নামমাত্র সংগঠন। তারাও প্রচারে বাংলা ভাষার সুদিন ফেরানোর প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে। তৃণমূল প্রার্থী অঞ্জনা মাহাতো জামশেদপুরের এক প্রচার সভায় বলেন, ‘‘দিদির দল তৃণমূলই একমাত্র ঝাড়খণ্ডে বাংলা ফেরাতে পারে।’’
পুরুলিয়ার শালবনির বাসিন্দা অঞ্জনা জামশেদপুরে ঘাটি গেড়ে প্রচার চালাচ্ছেন দিনভর। বরহাগোড়া, পোটকা, যুগসরাই, ঘাটশিলা, জামশেদপুর-পূর্ব ও জামশেদপুর-পশ্চিম— ছ’টি বিধানসভা কেন্দ্র নিয়ে জামশেদপুর লোকসভা। জামশেদপুর জুড়ে কোনও দেওয়াল লিখন নেই। নেই ফ্লেক্স বা হোডিংয়ের রমরমা। ভোট আসছে বোঝা যায় শুধু প্রার্থীদের রাস্তায় ঘুরে ঘুরে প্রচার দেখে। বিজেপি প্রার্থী বিদ্যুৎ মাহাতো ও ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা ও কংগ্রেসের জোট প্রার্থী চম্পাই সোরেনের মধ্যে জোর টক্কর।
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
ঝাড়খণ্ডে কংগ্রেস এবং জেএমএমের জোটের হাওয়া যথেষ্টই শক্তিশালী বলে মত স্থানীয়দের। জেএমএম সমর্থকদের দাবি, তাঁরা আদিবাসী ভোট তো পাচ্ছেনই, সেই সঙ্গে বাঙালিদের ভোট পেলে তাঁরাই জিতছেন। জেএমএম জিতলে এ বার বাংলা ভাষার সুদিন ফিরবেই। অন্য দিকে জামশেদপুরে এক সভায় বিদ্যুৎ মাহাতোর দাবি, ‘‘বাংলা পাঠ্যবই ছাপানোর কাজ কলকাতার একটি ছাপাখানা থেকে শুরু হবে। মোদীজিই ফেরাবেন বাংলা ভাষার সুদিন।’’
স্থানীয় এক বাঙালি বাণীপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘কোনও দলই কিন্তু সত্যি করে বাংলা ভাষার সুদিন ফেরানো নিয়ে গত ১৯ বছর ধরে ভাবেনি। বাংলা ভাষাকে ফেরানোর দাবিতে বাঙালিদের সব ভোট যদি কোনও এক জন প্রার্থীর ইভিএমে পড়ত, তা হলে কিন্তু সেই প্রার্থী জিতে যেতেন। তবে বাঙালিরাও কোনও দিন সঙ্ঘবদ্ধ হতে পারেননি।’’
বাংলা স্কুলগুলি যে ধুঁকছে, তা জামশেদপুরের বাংলা মাধ্যম স্কুল সাকচী হাইস্কুলে গিয়েই বোঝা গেল। বাংলার পাশাপাশি এই স্কুল এখন হিন্দি মাধ্যমেও চলে। এই স্কুলের শিক্ষক অসিত কুমার ঘোষ বলেন, ‘‘২০১০ সাল থেকে বাংলা বই নেই স্কুলে। ছাত্রও কমে কমে তলানিতে ঠেকেছে। হিন্দি পাঠ্য বই অনুবাদ করে বাংলা পড়াই। অথচ যখন বিহার ছিল
রাজ্যটা, তখন কিন্তু বাংলা বই পেত সরকারি স্কুলগুলি।’’
তৃণমূল প্রার্থী অঞ্জনাদেবীর দাবি, এখান থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে পুরুলিয়ায় গিয়ে দেখুন সেখানে বাংলার লোকশিল্পীদের জন্য দিদির সরকার কত কিছু করেছে। শিল্পীদের আলাদা সরকারি পরিচয়পত্র রয়েছে। সরকারি অনুষ্ঠান পান শিল্পীরা। এখানে কিছুই হয় নি। আমরা জিতলে সব স্কুলে বাংলা বই আসবে। বাঙালি লোক শিল্পীদের সরকারি পরিচয়পত্র হবে।
যদিও তৃণমূলের এই আশ্বাসে মন ভুলছে না জামশেদপুরের বাঙালিদের। তাঁদের মতে, তৃণমূলের তো কোনও শক্ত মাটিই নেই জামশেদপুরে। তাঁরা ফেরাবে বাংলা? এ বারের তৃণমূলের এই প্রার্থীকে কত জন চেনেন?
২০০৯ সালের লোকসভা ভোটে জেএমএমের সাংসদ সুনীল মাহাতোর স্ত্রী সুমন মাহাতো দাঁড়িয়েছিলেন তৃণমূলের টিকিটে। তিনি খুবই পরিচিত মুখ ছিলেন। তাঁরই তো জামানত জব্দ হয়েছিল।