হিরমা বাই। —নিজস্ব চিত্র।
হিরমা বাই আজও ভাল বুঝতে পারেন না, তাঁর অপরাধটা কী। গত বছর আষাঢ় মাসে একটা বিয়ে উপলক্ষে মুক্কি গিয়েছিলেন। মধ্যপ্রদেশের বনাঞ্চল সম্পর্কে যাঁদের ধারণা আছে, বিশেষ করে ভ্রমণপিপাসুদের কাছে, কানহা অভয়ারণ্যের মুক্কি গেট খুবই পরিচিত এবং লোভনীয় উচ্চারণ। ষাট বছরের হিরমা বাইগা জনজাতির মেয়ে, মুক্কি থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরে সিজোরা গ্রামে তাঁর ঘর। সেখানেই বসে তাঁর নিজের ভাষায় শোনাচ্ছিলেন গল্পটা। অনুবাদ করে দিলেন সিজোরার প্রাক্তন সরপঞ্চ সুখচাঁদ মাকরাম।
‘‘আমি তো মেয়েকে নিয়ে হেঁটে হেঁটে ফিরছিলাম। পথের মধ্যে দেখি, শালগাছের তলায় অনেক পুটপুরা (এক ধরনের ছত্রাক, স্থানীয় নাম) হয়ে রয়েছে। পুটপুরা আমরা তরকারিতে খাই, বেসন দিয়ে ভাজা খেতেও বেশ লাগে। ভাবলাম, ক’টা তুলে নিয়ে যাই। বনের সেপাইরা দেখতে পেয়ে আমায় ধরে নিয়ে গেল।’’ বর্ষাকালে শাল-সরাই গাছের তলায় পুটপুরা অজস্র হয়। তা-ই কোঁচড়ে করে নেওয়ার জন্য হিরমা আর তাঁর মেয়ের বিরুদ্ধে অরণ্য আইনে মামলা হয়েছে। বাইহারের আদালতে জামিন করে তাঁদের ছাড়াতে হয়েছে। এখনও সে মামলা চলছে। দিনমজুরি করে খাওয়া হিরমা ভারী বিপদে পড়েছেন। এ যেন পাতালকোঁড় তোলার অপরাধে দুর্গাকে জেলে ভরা! সংরক্ষিত অরণ্য কোথায় কোর, কোথায় বাফার, হিরমাদের বোধের বাইরে। এখন আদালতে হাজিরা দিতে গিয়ে মাঝে মাঝেই কাজে কামাই পড়ছে। উঠোন ভর্তি করে শুকোতে দেওয়া মহুয়ার গন্ধ ডিঙিয়ে হিরমার মেয়ে সুখবন্তী ঘর থেকে বের করে আনেন একটা চিরকুট। তাতে পেন দিয়ে লেখা, পেশী ৩০/৪/১৯। মানে ওই দিন ফের আদালতে পেশ হতে হবে।
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
জঙ্গলের ধারে বাস, জঙ্গলের সঙ্গেই একাকার বনবাসীদের জীবন। ভারী কাঠ, বাঁশ সংগ্রহ করার দায়িত্ব পুরুষদের। কিন্তু রোজের লকড়ি, কেন্দু পাতা, ফলপাকুড়, জড়িবুটি আনতে মুহুর্মুহু বনে ঢুকতে হয় মেয়েদেরই।
রামকলি ধুরুয়ে তো রাগে, দুঃখে জঙ্গলে ঢোকা ছেড়ে দিয়েছেন। সিজোরার কাছেই আর একটা গ্রাম খুরসিপার। সেখানে রামকলি আর তাঁর স্বামী দেওলাল ধুরুয়ে-র নতুন বাড়ি। আদি বাড়ি ছিল চিলপি এলাকার রোল গ্রামে। গত কয়েক বছরে বালাঘাট জেলার অন্তত ১৮-২০টা গ্রাম উৎখাত করেছে বন দফতর। বনের কোর এলাকার মধ্যে থাকা ঝোলার, বেন্ডা, আজানপুর, লিঙ্গা, জামি, সুখরির মতোই রোল গ্রামও উঠে গিয়েছে। উঠে গিয়েছে মানে? সুখচাঁদ বুঝিয়ে দেন, ‘‘সরকার পরিবারগুলোকে দশ লাখ করে টাকা দিয়ে জয়রামজি কি বলে দিয়েছে। স্বামী-স্ত্রীর জন্য দশ লাখ। আর ১৮ বছরের বেশি বয়সের ছেলেমেয়ে থাকলে তার দশ লাখ। এ বার যে যা পারো দেখে নাও।’’
রামকলিদের ভাগ্য ভাল, তাঁরা খুরসিপার-এ কিছু জমি কিনতে পেরেছেন। টাকা একেবারে উড়ে যায়নি। চিরকাল যে লকড়ি বন থেকে নিজে জোগাড় করে আনতেন, এখন পয়সা দিয়ে কিনছেন। ‘‘আমার ঘরবাড়িগুলোই তো জঙ্গল হয়ে গেল। আমি আর জঙ্গলে যাব না,’’ রামকলির ময়লা হয়ে যাওয়া রুপোর নাকছাবি অভিমানে জ্বলজ্বল করে।
অর্থাৎ? এক দিকে সেপাইদের নজরদারি, অন্য দিকে উচ্ছেদের খাঁড়া। দুয়ের মাঝে হাঁসফাঁস করছেন মধ্যপ্রদেশের বনবালারা। আর তাঁদের চোখের সামনে কানহা-পেঞ্চ-বান্ধবগড় উপচে পড়ছে পর্যটকদের ভিড়ে। সরকারি বয়ান বলবে, পর্যটনে তো এলাকারই উন্নয়ন। পেঞ্চ-কানহায় গাইড-এর কাজে স্থানীয় মেয়েদের নেওয়া হচ্ছে। নারী স্বশক্তিকরণের বিজ্ঞাপন হিসেবে তার প্রচারও হচ্ছে বড় করে। অদূর ভবিষ্যতে মুক্কি জ়োন-এর দায়িত্ব পুরোপুরি মেয়েদের হাতেই ছেড়ে দেওয়া হবে, পরিকল্পনা চলছে।
কথা হচ্ছিল ধনতি মারাওয়ে-র সঙ্গে। ২০১২ থেকে গাইডের কাজ করছেন। কাজ করতে করতে প্রাইভেটে বিএ-ও করে নিয়েছেন। সকাল, বিকেল জিপসি গাড়িতে পর্যটকদের নিয়ে যাওয়া। বিদেশিদের সঙ্গে কাজ চালানোর মতো ইংরেজিও রপ্ত হয়ে গিয়েছে। ধনতিই বললেন, এখন ৮ জন মহিলা গাইড আছেন কানহায়। সকলকেই মুক্কিতে থাকতে হয়। প্রথম যখন কাজ শুরু করেন--- বাড়ি ছেড়ে অন্য গ্রামে ঘর ভাড়া করে একলা থাকা— ধনতির জীবনটাই পাল্টে গিয়েছিল। এখন বিয়ে হয়েছে। মুক্কিতেই সংসার পেতেছেন। বললেন, খুব ভাল লাগে কাজ করতে। ইউনিফর্ম পরে যখন বেরোই, মনে খুব আনন্দ হয়। শ্বশুরবাড়িতেও আপত্তি করে না।
ধনতির বাপের বাড়ি কিন্তু পানারিখেড়া গ্রামে। মণ্ডলা জেলার বিছিয়া ব্লকে মোতিনালা রেঞ্জ অফিসের একেবারে গা ঘেঁষা গ্রামটা। দলিত অধ্যুষিত। অরণ্যভূমির পাট্টা পাননি প্রায় কেউই। পাট্টাহীন বনবাসীদের উৎখাত করার যে রায় দিয়েছিল সুপ্রিম কোর্ট, তাতে সবচেয়ে বেশি মানুষের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কথা ছিল মধ্যপ্রদেশেই। আপাতত সে রায় স্থগিত হয়েছে। কিন্তু আতঙ্ক স্বাভাবিক ভাবেই দূর হয়নি। স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কর্মীরা পাট্টা বের করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছেন। পানাড়িখেড়ার মেয়েরা বললেন, ‘‘জঙ্গল ছাড়া জীবন আমরা ভাবতেই পারি না। সকালের দাঁতনটাও তো জঙ্গল থেকেই আসে। সেপাইয়ের নজর এড়িয়ে পিছনের রাস্তা দিয়ে জঙ্গলে যাই। জানোয়ার নয়, মানুষকেই আমাদের ভয়।’’
সরাহি গেটের কাছে খিকসাটাঁড়-এও ফের ভয় ছড়াচ্ছে। মধ্য সত্তরে কানহা যখন প্রথম সংরক্ষিত অরণ্য হল, তখন প্রথম দফায় উচ্ছেদ হওয়া গ্রামগুলোকে জমি সমেত নতুন এলাকায় পুনর্বাসিত করা হয়েছিল। খিকসাটাঁড় তেমনই একটা। এত দিন মোটামুটি নির্বিঘ্নে কাটলেও এ বার তাঁরা শুনছেন, কানহা আরও বাড়বে। বালাঘাট-মণ্ডলার সঙ্গে দিন্দোরির জঙ্গল অদূর ভবিষ্যতে সংযুক্ত করা হতে পারে। সেটা হলে মাঝখানে থাকা ২০০ গ্রাম আবার উচ্ছেদ হবে।
উচ্ছেদ, উৎখাতকে ওঁরা বলেন বিস্থাপন। এই তৎসম শব্দটি এখন কানহার বাতাসে পাখির ডাকের চেয়েও বেশি শোনা যাচ্ছে। খিকসাটাঁড়ের মেয়েরা দল বেঁধে একটা দাওয়ায় এসে বসেছেন। কেউ একটা বাক্য বলছেন তো কেউ আর একটা। সেগুলো জুড়লে তৈরি হয়ে যাচ্ছে কথার মালা। ‘‘জঙ্গল তো চিরকাল আমরাই বাঁচিয়ে এসেছি। জঙ্গল বেঁচেছে, জানোয়ার বেঁচেছে, আমরাও বেঁচেছি। এখন শুনছি, আমাদের না তাড়ালে নাকি জঙ্গল বাঁচবে না। বুঝি না এ সবের মানে। কানহা কানহার মতো থাক না যেখানে আছে, আমরা আমাদের মতো থাকি। আমরা কি জঙ্গলের কেউ নই?’’
সরকারি স্যুভেনির শপে বাইগা মেয়েদের গয়না সাজানো থাকে ট্যুরিস্টদের জন্য। বনের ফলকে লেখা থাকে, বন হ্যায় তো হম হ্যায়। কানহার ভূমিকন্যারা চাল বাছতে বাছতে ভাবেন, বাঘ তো জানা ছিল, জঙ্গলও কি তবে নরখাদক হল?