যশোদাবেন। নিজস্ব চিত্র
দুই কামরার ঘুপচি ঘর। থম মারা দুপুর। নিষ্পলক চোখ তখন ফ্ল্যাশব্যাকে।
‘‘জানেন, এই চৌকাঠ পেরিয়েই বিয়ে করতে এসেছিলেন নরেন্দ্র মোদী। তার পরে হঠাৎ কী যে হল? এত বছর হয়ে গেল, বোনের না কোনও খবর নেন, না কোনও চিঠি! কিন্তু বোন বলেছে, নরেন্দ্র মোদী এক দিন না এক দিন তাঁর কাছে ফিরবেনই।’’
যে ‘বোন’-এর কথা বলছেন, তিনি যশোদাবেন। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর স্ত্রী। বিয়ের পর গৃহত্যাগ করে যাঁর সঙ্গে আর ঘর করেননি মোদী। আর ধুলোমাখা শরীরে মেঝেতে বসে যিনি এই কথাগুলো বলছেন, তিনি সম্পর্কে মোদীর ছোট শ্যালক, কমলেশ। অন্ধকার ঘরের প্রতি কোনা থেকে দারিদ্র ঝরে পড়ছে। কাছের এক কারখানায় কাজ করেন। সংসার চালাতে দু’কামরার ঠাসাঠাসি ঘরেই ছোট দোকান। এটাই যশোদাবেনের বাপের বাড়ি।
যশোদাবেন। ভোটে না-থেকেও তিনি ভোটে। গত লোকসভা ভোটে প্রথম বার নিজের নির্বাচনী হলফনামায় স্ত্রী হিসেবে যশোদাবেনের নাম লেখেন মোদী। সামনের সপ্তাহে বারাণসী থেকে মনোনয়ন পেশের সময়েও ফের লিখবেন। প্রধানমন্ত্রীকে আক্রমণের সময় যশোদার কথাই বারবার টেনে আনেন বিরোধী দলের নেতারা। শরদ পওয়ারও কাল বলেছেন, “মোদী কী করে জানবেন, পরিবার কী করে চালাতে হয়?” মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও বলেন, “ঘরের মেয়েদের কথা আপনি কী বুঝবেন? নিজের স্ত্রীকে প্রাপ্য সম্মান দিয়েছেন?”
এমনকি, ভোট বাজারে মোদীর যে-বায়োপিক নিয়ে বিজেপির এত লম্ফঝম্প, তাতেও যশোদার একটি চরিত্র আছে। সেই যশোদার অপেক্ষাতেই বসে আছি। উঞ্ঝাতে বড় ভাই অশোক মোদীর কাছেই থাকেন যশোদা। কিন্তু সেখান থেকে বেরিয়ে গিয়েছেন। খবর পেয়েছিলাম, পাঁচ মিনিটের জন্য আসবেন ব্রাহ্মওয়াড়ার এই পুরনো বাড়িতে। পঞ্চায়েতের সঙ্গে কোনও আলোচনা আছে। কিন্তু কমলেশ আগেই সাবধান করে দিয়েছিলেন, “বোনের সঙ্গে কমান্ডো থাকেন। তাঁরা কথা বলতে দেবেন না। ভোটের সময়। অনেক দিক থেকে নানান ধরনের লোক আসেন। আমার বোন প্রাইম মিনিস্টারের স্ত্রী তো!”
আধ ঘণ্টার অপেক্ষা। একটি সাদা গাড়ি এসে থামল বাড়ির সামনে। এক, দুই, তিন, চার…সাদা পোশাকের চার নিরাপত্তাকর্মী। সঙ্গে অশোক, তাঁকে আগেও দেখেছি। সবার শেষে নামলেন তিনি। কপালে লাল টিপ, লাল শাড়ি, লাল রঙের পলা। হাতে লাল রং মাখা, নিশ্চয় কোনও মন্দির থেকে এসেছেন। মুখে হাসি। হঠাৎ মনে পড়ল কমলেশের কথা, “আমার বোনকে দেখলে বুঝবেন না, তিনি দেশের ‘প্রাইম মিনিস্টার’-এর স্ত্রী। খুব সরল, সাধাসিধা।”
এর পরের মিনিট দশেক যা ঘটল, তা প্রত্যাশিতই ছিল। নতুন আগন্তুককে দেখে ছুটে এলেন দুই নিরাপত্তাকর্মী। এক জন গেলেন গাড়ির চালকের কাছে। কে, কেন, কোথা থেকে? পরিচয়পত্র দিন। তার ছবি তুলেও নিশ্চিন্তি নেই। মোবাইল নম্বর? আমার ছবি, ভিডিয়োও তোলা হল। সব দেখে কিছুটা স্বস্তি পেয়ে নিরাপত্তার লোকজন: “বোঝেনই তো, সবকিছু আমাদের পাঠাতে হয় ‘হোম মিনিস্ট্রি’তে। ভোটের সময়। অনেকে হুটহাট চলে আসছেন। এই গাড়ি দেখছেন? দেখে মনে হচ্ছে বেসরকারি, কিন্তু সরকারি গাড়ি।”
ভোটের সময় যশোদাবেনের সঙ্গে সনিয়া গাঁধীও নাকি দেখা করতে চেয়েছিলেন। সাংবাদিকরাও আসছেন। সতর্ক নিরাপত্তাকর্মীরা। বলছেন, “দেখুন, কথা বলতে দিতে আমাদের আপত্তি নেই। শুধু ভোটের সময় তো! ওঁর (যশোদাবেন) দিল্লি থেকেও এক আমন্ত্রণ এসেছিল। তাঁর যাওয়া পাকাও ছিল। কিন্তু এখন জানি না, অনুমতি পাওয়া যাবে কি না।” দুই কামরার ঘরে চেয়ারে তখন বসে গুজরাতিতে ভাই-বোনেরা দিব্য কথা বলছেন। এক জন নিরাপত্তাকর্মী ডেকে বললেন, “এক মিনিটের জন্য কথা বলে নিন। আমাদের সামনে।”
তাঁরা আশ্বস্ত। কিন্তু যশোদাবেনের দাদা অশোক নন। ঘড়ি ধরে পরের এক মিনিট শুধু দাদা-ভাই-নিরাপত্তাকর্মীর মধ্যে টেনিস ম্যাচের মতো ঘাড় এ-দিক থেকে ও-দিক ঘোরালেন যশোদা। শুধু একটিই প্রশ্ন করতে পারলাম, “পথ দুর্ঘটনার পরে আপনার কোনও খবর পাইনি আমরা। আপনি ভাল আছেন তো?” একগাল হেসে যশোদা বললেন, “আমি ভাল আছি। পূজাপাঠ নিয়েই থাকি।”
কথা কেড়ে নিয়ে সন্দিগ্ধ চাউনিতে অশোক মোদী: আপনি দিল্লি থেকে এসেছেন? কে পাঠিয়েছেন?
নিরাপত্তাকর্মী: আমরা দেখে নিয়েছি।
অশোক মোদী: না, দিল্লি বলেই সন্দেহ হচ্ছে।
আমার প্রশ্ন: ভোট নিয়ে কিছু বলবেন?
কমলেশ মোদী (যাঁর সঙ্গে এতক্ষণে অনেকটাই সখ্য হয়েছে): কালও কংগ্রেসের অনেক লোক এসেছিলেন। বলেছিলেন, নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে কিছু বলুন। কিন্তু বোন জানিয়ে দিয়েছেন, একটি কথাও বলবেন না। নরেন্দ্র মোদী যেখানে আছেন, আরও এগোবেন। বিজেপিকেই ভোট দেবেন।
অশোক মোদী: তুই থাম।
কিন্তু হাসি আরও চওড়া হল যশোদাবেনের।
ভোট নিয়ে কথা হতেই নিরাপত্তাকর্মীরা বললেন, “এক মিনিট হয়ে গিয়েছে। চলুন।”
তাঁরাও বেরোলেন। আমারও যাওয়ার পালা। মোদীর শ্বশুরবাড়ির গ্রাম থেকে বেরিয়েই বড় রাস্তা। পেল্লায় পোস্টারে হাসছেন মোদী— ‘মজবুর নয়, মজবুত সরকার। ফের এক বার মোদী সরকার’।