তখন আমি বড্ড ছোট। ছুটির দিন দুপুরবেলা মানে আমাকে ভাতঘুম দিতেই হবে, একদম বাধ্যতামূলক। সেইরকমই এক দুপুরে দেখতাম মা, ঠাকুরমা, বাবা আমাকে পিসির হেফাজতে ফেলে রেখে কোথায় যাচ্ছে। ফিরে এলে দেখতাম, বাঁ হাতের তর্জনীতে বিশেষ দাগ। নীল-সবুজ রঙের নেলপালিশ তখন সচরাচর দেখা যেত না , তাই এই বিচিত্র বেগুনি রঙের দাগটি দেখতে পেলে আমি বেশ বিচলিত হয়ে পড়তাম। কান্নাকাটি পর্যন্ত বিষয়টা গড়াত। মা বলতেন, ‘‘এটা একমাত্র বড়দের পরার অধিকার আছে।’’
জলভরা চোখে ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকতাম আর মনে মনে ভাবতাম, মা যখন বলে বোনের থেকে বড় আমি, এত বড় মেয়ে হয়ে সামান্য কথায় কাঁদতে নেই, তখন ঠিক কতটা বড় আমি? গণ্ডিটা কবে পেরোলে এই নেলপালিশটা পরতে পারব? পর দিন স্কুলে গিয়ে বন্ধুদের নখেও খুঁজতাম রংটা। নেই দেখে বড় শান্তি পেতাম।
তখন আগের থেকে একটু বড় হয়েছি। মা আমাকে সঙ্গে করেই নিয়ে গেল এমন এক দিনে। স্কুলবাড়ি, কিন্তু যাহ! একজনও তো স্কুলে পড়া বাচ্চা নেই! মা-বাবারা এসেছে! আবার পুলিশও আছে! বেশ মজা লেগেছিল। তবে সেদিন আমার প্রবেশ নিষেধ ক্লাসরুমে। বেশ বিচিত্র দিন বটে!
মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরোই।স্কুল মানেই মনিটর, প্রিফেক্ট হওয়ার লড়াই লেগে থাকত বছরের এক সময়ে। এ-ও এক ধরনের রাজনীতি। তবে রাজনীতি হিসেবে তখন বুঝতাম না। মনিটর হলে ক্লাসে সবাই কথা শুনবে, প্রিফেক্ট হলে ছোট ক্লাসের সবাই কথা শুনবে, বড় দিদি বলে মানবে। এটাই তখন আমাদের মনের মধ্যে চলতো। কিন্তু এ যে বড় সহজ বিষয় নয়। স্কুলের আয়তনে আমরা এই সব পদে যাদের নির্বাচিত করছি, দেশের প্রেক্ষিতে তা করে গোটা ভারতবর্ষের মানুষ। সাধারণ জনতা।
কলেজে পা দিলাম। কলেজে পড়ি আর রাজনীতি করব না তা কি হয় ? বিভিন্ন কলেজে পড়ে আমার বন্ধুরা। কারও মতে, ‘‘স্ট্যাচু অব ইউনিটিতে টাকা খরচ না করে গরিবদের ভাত ডাল খাওয়ানো যেত না?’’ কেউ বলে, ‘‘সাইকেলেই খুশি আছি।’’ কেউ আবার বলে, ‘‘সবাই ভোট আদায় করার রাস্তা খুঁজছে! মানুষের ভাল বোঝে কে?’’ দলাদলি এত। কোন দলে নাম লেখাব, বুঝে উঠতে পারা যায় না। ভেবেছিলাম এত যে দল, কোনও কি জায়গা হবে না? কিন্তু দলের আহ্বানের সেই হাতের নমস্কার স্বাগতম জানায়নি কোনও মনের অভ্যন্তরে। চেয়েছে শুধু ভোট।
দলে দলে মানুষ চলেছে ব্রিগেডের পথে। সারি সারি বাস দাঁড়িয়ে আছে এজেসি বোস রোড ঘেঁষে। মাথায় একটা টুপি লাগিয়ে মানুষ চলেছে। মেট্রোতে ভিড়, বাস নেই। সবাই ছুটছেন দলের জমায়েতে। কী চাই, কেন চাই, সকলেই কি জানেন? অদ্ভুত ব্যাপার হল, আইপিএল না দেখলে নাতি বলবে, ‘‘উফ দাদু, একটু আপডেটেট থাকো এ সবের সম্পর্কে।’’ ভোটের কথা বলতেই এদের অনেকেই আবার বলবে, ‘‘কিছুতেই হবে না দেশের উন্নতি। ভেবে কী লাভ?’’ আবার কেউ ভাবেন, ‘‘আমার ভোটে কী বা এসে যাবে? আজ দুপুরে ভাতঘুম দেব!’’ আমি যে ভাতঘুম না দিয়ে ভোটের দিনের কালি লাগাতে যেতে চাইতাম কিছু না বুঝে, কেউ কেউ সেই কালি ও ভোটের গুরুত্ব বুঝেও ভাতঘুমের কামনা করে।
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
একটা ভোট দেশ বদলে দিতেই পারে। অতি গরিব ঘরের মানুষের তিনটি মাত্র মৌলিক চাহিদা— খাদ্য, বস্ত্র ও বাসস্থান। এই তিনটি যেন প্রতিটি মানুষ লাভ করে। সরকারের থেকে এটাই কাম্য। এমন প্রার্থীকে যেন আমরা দেখতে পাই, যাঁরা সারা বছর মানুষের জন্য কাজ করবেন। ভোটের সময় শুধু নয়, সারা বছর তাঁদের যেন কর্মরত দেখতে পারি। রাজ্য সরকার এবং কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন পদে যেন নিয়োগ হয়। মেধাকে গুরুত্ব দেওয়া হোক।
রাজ্য, কেন্দ্রে সরকার আমাদের হাতেই তৈরি হবে, তিনি রাজা বা রানি –যিনিই হোন না কেন। না হলে, সময় আবার আসবে, যখন মানুষই দড়ি ধরে মারবে টান, আর রাজা বা রানি হবে খান খান।
(লেখিকা সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের স্নাতক স্তরের ছাত্রী)