প্রতীকী ছবি।
গত বছরের নভেম্বর মাসে ছত্তীসগঢ়ের বিধানসভা ভোট। কংগ্রেস বনাম বিজেপির জোর লড়াই। রায়পুরে ভোটগ্রহণের দিন ভাড়া করা গাড়ির চালক সকাল থেকেই খোশমেজাজে। কারণ, আগের রাতে ঘরে বসে ৮০০ টাকা আয় হয়েছে। এক দলের প্রার্থী হাতে ৩০০ টাকা গুঁজে দিয়ে গিয়েছিলেন। তাঁকে টেক্কা দিতে পরে অন্য এক দলের প্রার্থী এসে ৫০০ টাকার নোট ধরিয়ে দিয়ে গিয়েছেন।
এ বার লোকসভা ভোটে সেই ছত্তীসগঢ়। সেই রায়পুর। ভোটের আগের দিন শোনা গেল, চার-পাঁচ মাসে ‘রেট’ বেড়ে গিয়েছে। প্রার্থীরা ১ হাজার টাকা অবধি উঠছেন। ছত্তীসগঢ় থেকে উত্তরপ্রদেশে গিয়ে দেখা গেল, প্রার্থীরা আরও দরাজ। কেউ কেউ দু’হাজার টাকা পর্যন্তও উঠছেন। সঙ্গে মদের বোতল, স্কুটার-বাইকে তেল ভরে দেওয়া, অন্যান্য উপহার তো রয়েছেই।
এ বারের লোকসভা ভোট ঘোষণার পর থেকে এখনও পর্যন্ত ৩ হাজার ৩৮৬ কোটি টাকার নগদ, মদের বোতল, মাদক ও উপহার আটক হয়েছে। ১০ মার্চ ভোট ঘোষণা হয়েছে। যার অর্থ, দিনে গড়ে ৫৬ কোটি টাকা আটক হয়েছে। সব রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে এ বারের ভোট। ২০১৪-র লোকসভা ভোটে মোট ১২০০ কোটি টাকার নগদ-মদ-মাদক-উপহার আটক হয়েছিল। ২০১৯-এ ভোটপর্ব শেষ হওয়ার আগেই আটকের পরিমাণ তিন গুণ বেশি। লোকসভা ভোটের ইতিহাসে এই প্রথম তামিলনাড়ুর ভেলোরে বিপুল পরিমাণ নগদ উদ্ধারের পর ওই লোকসভা কেন্দ্রের ভোটগ্রহণই বাতিল করতে হয়েছে। বৃহস্পতিবার রাতে ‘বেআইনি’ টাকা রাখার অভিযোগ উঠেছে ঘাটালের বিজেপি প্রার্থী ভারতী ঘোষের বিরুদ্ধে।
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
হিংসার নিরিখে পশ্চিমবঙ্গ রোজ খবরে উঠে এলেও, রাজ্যে নগদ-উপহার আটকের পরিমাণ ১০৫ কোটি ৭৮ লক্ষ টাকা। ভোটের আগে নগদ টাকা, শাড়ি, গয়না থেকে মদের বোতল বিলির রেওয়াজে বরাবরই দক্ষিণ ভারত এগিয়ে। তামিলনাড়ু, অন্ধ্রপ্রদেশ, গুজরাতের মতো রাজ্যের তুলনায় পশ্চিমবঙ্গ এখনও অনেক পিছিয়ে।
প্রশ্ন উঠেছে, আগে হুমকি-মারধর দিয়ে ভোটারদের ভয় দেখানো হত। তার বদলে কি এখন টাকা-উপহার দিয়ে ভোটারদের প্রভাবিত করা হচ্ছে? আর টাকা-নগদ বিলিতে পশ্চিমবঙ্গ এখনও অন্য রাজ্যের তুলনায় পিছিয়ে বলেই কি পশ্চিমবঙ্গে ভোট ঘিরে হিংসা বেশি?
প্রাক্তন মুখ্য নির্বাচন কমিশনার ও পি রাওয়ত বলেন, ‘‘নির্বাচনে হিংসার কারণ অনেকটাই স্থানীয়। যেখানে রেষারেষি, ব্যবধান খুব কম হওয়ার সম্ভাবনা, কোনও বুথে শ’খানেক বা হাজার ভোট ছাপ্পা দিতে বা ভোটারদের আটকে দিতে পারলেই ফলাফল ঘুরে যায়, সেখানেই হিংসা বেশি। তার সঙ্গে নগদের সম্পর্ক টানা যায় না।’’ কিন্তু গোটা দেশে যে ভোটে বিপুল পরিমাণ টাকা ছড়ানো হচ্ছে, তা মানছেন রাওয়ত। তিনি বলেন, ‘‘রাজনৈতিক নেতারা বিপুল লগ্নি করছেন ভোটে। যা ধরা পড়ছে, তা হিমশৈলের চূড়ামাত্র বলেই ধরে নেওয়া যায়।’’
প্রাক্তন মুখ্য নির্বাচন কমিশনার এস ওয়াই কুরেশিরও মত, ‘‘এই বিপুল পরিমাণ নগদ-মদ-উপহার উদ্ধার থেকে দু’টি বিষয় স্পষ্ট। তা হল, ভোটে বিপুল পরিমাণ টাকা কাজে লাগানো হচ্ছে। দুই, নির্বাচন কমিশন ও নজরদারি বাহিনী খুব ভাল কাজ করছে, কিন্তু তার পরেও টাকা ওড়ানো পুরোপুরি বন্ধ করা যাচ্ছে না।’’
তবে টাকার ব্যবহার বেশি হচ্ছে বলেই হিংসা কমে গিয়েছে বলে মানতে রাজি নন কুরেশি। তাঁর যুক্তি, ‘‘এক গুন্ডা আগে ডান্ডা মেরে ভোটারদের ভয় দেখাত। এখন সে ডান্ডা ছেড়ে শুধুই টাকা দিয়ে ভোটারদের খুশি করছে, এমনটা মনে হয় না।’’ কুরেশির বক্তব্য, ‘‘হিংসা কমেছে, তার কারণ নির্বাচন কমিশন স্পর্শকাতর বুথ, অতি স্পর্শকাতর বুথ চিহ্নিত করে অফিসার, নিরাপত্তা বাহিনী মোতায়েন করে।’’
বিজেপির ‘গুন্ডামি’ নিয়ে সরব রয়েছেন আগে থেকেই, এ বার পশ্চিমবঙ্গে টাকা ছড়িয়ে ভোট কেনারও অভিযোগ এনেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর কথায়, ‘‘দেখেছেন তো বিজেপির এক প্রার্থী কয়েক কোটি টাকা নিয়ে ধরা পড়েছে। ভোটের আগে দুষ্কৃতীদের সেই টাকা দিয়ে বলা হচ্ছে ভোট দখল করো। গরিব লোককে খাওয়াও। এটা নির্বাচন?’’ দলীয় কর্মীদের প্রতি তাঁর নির্দেশ, ‘‘ভোটের আগে রাত জেগে পাহারা দিতে হবে। ওরা বাক্স বাক্স টাকা ঢোকাচ্ছে বাংলায়।’’
পশ্চিমবঙ্গে ভোটে নগদ ছড়ানো নিয়ে বৃহস্পতিবারই নির্বাচন কমিশনে অভিযোগ জানিয়েছেন কংগ্রেস নেতা প্রদীপ ভট্টাচার্য। আঙুল তুলেছেন কেন্দ্রের ও রাজ্যের দুই শাসক দলের দিকে। প্রদীপের কথায়, ‘‘পশ্চিমবঙ্গে আগে শুধু অনুন্নত এলাকায় গরিবদের মধ্যে চাল, শাড়ি বিলি হত। এখন সেই টাকার ব্যবহার বিপুল পরিমাণে বেড়েছে।’’ তবে টাকা ব্যবহারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে হিংসা কমছে বলে মানতে রাজি নন তিনি। তাঁর দাবি, টাকা যেমন আসছে, তার সঙ্গে সেই টাকায় অস্ত্র-গোলাগুলিও বাড়ছে।
সিপিএমের পলিটবুরো নেতা নীলোৎপল বসুরও মতে, ‘‘পশ্চিমবঙ্গে টাকা ও হিংসা একটা আর একটাকে আরও জোরদার করছে। তার থেকেও বিপজ্জনক হল, যত বেশি টাকা ছড়ানো হবে, ভোটের পরে সেই টাকা কামিয়ে নেওয়ার তাগিদও বেশি হবে।’’