নীতীশ কুমার
ঠা ঠা রোদে জনমনিষ্যি নেই কোথাও। লোহার গেট হাট করে খোলা। গেটের উপরে ‘আর্চ’। কোনও কালে তাতে কালো রংয়ে লেখা হয়েছিল, ‘বাবু জগজীবন সেবাশ্রম’। সে লেখাও এখন কষ্ট করে পড়তে হয়। ভিতরে ঢুকে বড় উঠোন। একতলা ‘এল’ আকৃতির ব্যারাক বাড়ি। বাড়ির পলেস্তারা খসে পড়ছে। কবেই যেন এলা রং করা হয়েছিল, দেওয়ালে এ দিক-ও দিক হাল্কা ছোপই তার সাক্ষী। সারি সারি পাঁচ সাতটা ঘর। সামনে টানা বারান্দায় গোটা তিনেক তক্তপোষ পাতা। খোলা উঠোনের একদিকে বাঁধানো কুয়ো। চার পাশেই দীর্ঘ অযত্নের ছাপ।
অধিকাংশ ঘরেই সস্তার তালা। দুটো ঘরের দরজা খোলা। ভিতরে জমাট অন্ধকার। গলা খাঁকারি দিতেই এক শীর্ণ বৃদ্ধ বেরিয়ে এলেন। পাশের ঘর থেকে উঁকি মারলেন দুই যুবক। কলকাতার ‘পত্রকার’, পরিচয় দিতেই বৃদ্ধ সাদরে বসালেন বারান্দার তক্তাপোশে। নাম প্রকাশ রাম। এক প্রান্তের একটি বন্ধ ঘর দেখালেন, ‘‘এখানে এলে এই ঘরেই থাকতেন বাবুজি।’’ টিনের নেমপ্লেটে অপটু হাতে লেখা ‘বাবু জগজীবন রাম’। বারান্দার অপর প্রান্তে আর একটি বন্ধ ঘরের দরজায় একই রকম নেমপ্লেট, জগজীবন-কন্যা ‘মীরা কুমার’-এর। অন্য ঘরগুলিতে থাকেন দলিত ছাত্ররা। কেউ সেবাশ্রমে থেকে কলেজে পড়েন। কেউ বা তৈরি হচ্ছেন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার জন্য।
‘পত্রকার’-কে হাতের কাছে পেয়ে প্রকাশবাবু শুরু করেন অতীত চর্চা, ‘‘অনেক বছর এখানে আছি। কত দিনবদল দেখলাম!’’ বাবুজিকে দেখেছেন সাতের দশক থেকে। আগে বাবুজি এলেই সেবাশ্রম জমজমাট হয়ে উঠত। কত নেতা আসতেন। গোটা সাসারামই কার্যত ভেঙে পড়ত। এখন আর কেউই আসেন না। সাসারামের দু’বারের সাংসদ মীরা কুমারও এ ধার বিশেষ মাড়ান না।
সাসারামের সঙ্গে বাংলার যোগাযোগ ‘গ্র্যান্ড ট্যাঙ্ক রোড’। হাওড়ার শিবপুর থেকে বেরিয়ে জিটি রোড সাসারামের বুক চিরে চলে গিয়েছে দিল্লি। এই পথের স্রষ্টা, ‘আফগান’ শের শাহ সুরির জন্ম এই সাসারামেই। মোগল স্থাপত্যের স্মৃতি নিয়ে শহরের বুকে এখনও দাঁড়িয়ে ‘শের শাহ দরওয়াজা’। প্রকাশবাবুর সংযোজন, শুধু জিটি রোডই নয়, বাংলার সঙ্গে সাসারামের যোগসূত্র স্বয়ং বাবুজি। কী ভাবে? ‘দলিত’ নেতা বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্পৃশ্যতার শিকার হন। হস্টেলে অন্য হিন্দু ছেলেদের সঙ্গে খাবার জুটত না তাঁর। বাইরে খেতে হত। বন্ধ ছিল নাপিতও। দু’-তিন মাসে এক দলিত নাপিত এলে তবেই তাঁর ক্ষৌরকর্ম হত। এই বঞ্চনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েই বিএইচইউ ছাড়েন জগজীবন রাম। ভর্তি হন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৩১ সালে কলকাতা থেকেই বিএসসি পাশ করেন তিনি। বৃদ্ধের প্রশ্ন, ‘‘কলকাত্তা সে জুড়ে হুয়ে না?’’ ঘাড় নাড়তেই হয়।
বাবু জগজীবন রাম। ১৯৪৬ সালে জওহরলাল নেহরুর অন্তর্বর্তী সরকারের কনিষ্ঠতম মন্ত্রী। কনস্টিটুয়েন্ট অ্যাসেমব্লির সদস্য। ১৯৫২ থেকে ১৯৮৪, ১৯৮৬ সালে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত টানা আট বার সাসারামের সাংসদ। আজকের সাসারামের উন্নয়ন ও অনুন্নয়ন—সব বিতর্কেই ঘুরে ফিরে ছায়া ফেলে যান এই দলিত নেতা। কেউ যাবতীয় উন্নয়নের জন্য কৃতিত্ব দেন বাবুজিকে। আবার অপর পক্ষ অনুন্নয়নের জন্য কাঠগড়ায় তোলেন তাঁকেই। ২০০৪ ও ২০০৯ সালে এখান থেকেই সাংসদ হন বাবুজির কন্যা, মীরা কুমার। ২০১৪ সালের মোদী ঝড়ে ধরে রাখতে পারেননি বাবার দুর্গটি। এ বার, আবারও কংগ্রেসের প্রার্থী লোকসভার প্রাক্তন স্পিকার। প্রকাশ রাম নিশ্চিত, বাবুজির দুর্গ তাঁর ‘বিটিয়া’-ই রক্ষা করবেন।
কিন্তু ‘বিটিয়া’র লড়াই তো শুধু বিজেপির বর্তমান সাংসদ ছেদি পাশোয়ানের সঙ্গে নয়। তাঁকে লড়তে হচ্ছে দলের বিভিন্ন গোষ্ঠীর সঙ্গেও। সেবাশ্রমের পাশেই জেলা কংগ্রেসের অফিস বাড়ি। অধিকাংশ সময় সেখানে তালা ঝুললেও ভোটের আগে ‘কার্যালয়’ জমজমাট। সেখানেই পরিচয় সিংহাসন সিংহের সঙ্গে। ভূমিহার ভোলাবাবুর বক্তব্য, বাপ-বেটি মিলে পঞ্চাশ বছর ধরে লোকসভায় সাসারামের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। কিন্তু সাসারামের যে উন্নতি হওয়ার কথা তা হয়নি। বাবুজি কেন্দ্রের বড় বড় দফতরের দায়িত্বে ছিলেন, উপ-প্রধানমন্ত্রীও হয়েছেন। কিন্তু সাসারামের জন্য কিছুই করেননি। মীরাজিও মন্ত্রী হয়েছেন, স্পিকার হয়েছেন। এখানকার জন্য কিছুই করেননি। বরং দু’টো চালু কারখানা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। প্রতিবাদ করলেন অন্য কংগ্রেসিরা, বাবুজি না থাকলে সাসারামকে কে চিনত? সিংহাসনের সঙ্গে মহাতর্ক বেধে গেল তাঁদের।
কিন্তু সাসারাম তো যথেষ্ট উন্নত। সার্কিট হাউস সংলগ্ন একটি কাফেতে বসে স্থানীয় বিজেপি নেতা অশোক পাণ্ডে বলেন, ‘‘স্বাভাবিক উন্নয়ন বলে একটা কথা আছে জানেন তো? এটা তাই।’’ তাঁর দলের সাংসদও যে বিশেষ কিছু করেছেন, এমন দাবি অশোকবাবু করলেন না। পূর্ব উত্তরপ্রদেশ লাগোয়া এই অঞ্চলটি বিহারের ‘ধান কা কটোরা’ হিসেবে পরিচিত হলেও এখানকার মানুষ ডাক্তার-বদ্যি থেকে শুরু করে বিয়ের বাজার, সব কিছুতেই দৌড়ন মাত্র ১১০ কিলোমিটার দূরের বারাণসীতে।
আসলে বিজেপির এ বারের বড় ভরসা, শরিক জেডিইউ নেতা নীতীশ কুমার। রয়েছে নরেন্দ্র মোদীর ‘বালাকোট স্ট্রাইক’-ও। গত বার
ছেদি জিতেছিলেন ৬০ হাজারের বেশি ভোটে। এ বার তা লাখ ছাড়াবে বলেই অশোকবাবুদের বিশ্বাস। সাসারামের ২৫ শতাংশ দলিত ভোট। বিজেপি নেতৃত্বের অঙ্ক: ব্রাহ্মণ, রাজপুত, ভূমিহার—উচ্চবর্ণের সিংহভাগ ভোট তাদের সঙ্গে। আর নীতীশের মহাদলিত নীতিই ‘বাপ-বেটি’র
দীর্ঘ দিনের ভোট ব্যাঙ্ককে তছনছ করে দিয়েছে। আশা, সেই মিলিত অঙ্কেই সাসারামকে বাবুজির ‘ছায়া’ থেকে তাঁরা বের করে আনতে পারবেন।