সিএএ-এনপিআর-এনআরসি-র বিরুদ্ধে দিল্লিতে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ। —ফাইল চিত্র
হিন্দু, খ্রিস্টান-সহ বিভিন্ন ধর্মের উৎসবের তালিকা রয়েছে। রয়েছে দুর্গাপুজো থেকে বড়দিন, বুদ্ধ পূর্ণিমা থেকে নানক জয়ন্তী, মহর্ষী দয়ানন্দ সরস্বতী জয়ন্তী থেকে ছটপুজো। আছে গাঁধী জয়ন্তী, স্বাধীনতা দিবস বা ইংরেজি নববর্ষের উল্লেখও। নেই শুধু মুসলিমদের কোনও ধর্মীয় উৎসবের উল্লেখ। জাতীয় জনসংখ্যা রেজিস্টার বা এনপিআর-এর সদ্য প্রকাশিত ম্যানুয়ালে এই বিস্ময়কর ধর্মীয় বৈষম্যের বিষয়টি নজরে আসতেই শুরু হয়েছে সমালোচনা। তবে এ ক্ষেত্রে বর্তমান নরেন্দ্র মোদী সরকার একা কাঠগড়ায় নয়। এর আগে, ২০১১ সালে মনোমোহন সিংহের জমানায় যে এনপিআর ম্যানুয়াল প্রকাশিত হয়েছিল, তাতেও কোনও মুসলিম ধর্মীয় উৎসবের উল্লেখ ছিল না।
এ দেশের ধর্মীয় জনসংখ্যার নিরিখে হিন্দুদের পরেই মুসলিমরা। ৩৭ পাতার এনপিআর ম্যানুয়ালের ৩২ নম্বর পাতায় অ্যানেক্সার ৫-এ দেশের গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় উৎসবের একটি তালিকা দেওয়া হয়েছে। সেখানে হিন্দু ছাড়াও বৌদ্ধ-খ্রিস্টান-শিখ ইত্যাদি বিভিন্ন ধর্মের উৎসবের সময়কাল উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু জনসংখ্যায় দ্বিতীয় স্থানে থাকা মুসলিমদের কোনও উৎসব বা স্মরণীয় দিন বা তিথির উল্লেখ নেই। কলকাতা হাইকোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি সমরেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো আরও অনেকেই এর মধ্যে ধর্মীয় বিভাজন বা বৈষম্য দেখতে পাচ্ছেন।
এনপিআর ম্যানুয়ালে ধর্মীয় উৎসব বা রীতির উল্লেখ কেন রয়েছে?
২০১১ সালের এনপিআর ম্যানুয়ালে তার কোনও ব্যাখ্যা দেওয়া ছিল না। ২০২০ সালের এপ্রিল মাস থেকে গোটা দেশে এনপিআর-এর জন্য তথ্য সংগ্রহের কাজ শুরু করতে চায় কেন্দ্র। সেই তথ্য সংগ্রহের সময় জন্ম তারিখ এবং স্থানের কথা জানাতে হবে এ দেশের বাসিন্দাদের। এ বারে ওই তালিকার ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে— অনেকেই নিজের জন্মের দিন ক্ষণ সঠিক মতো বলতে পারেন না। সে জন্য বড় কোনও ঐতিহাসিক ঘটনা অথবা বিভিন্ন সম্প্রদায়ের উৎসব বা ধর্মীয় রীতির কথা মনে করিয়ে সম্ভাব্য জন্মতথ্য নথিবদ্ধ করার নিদান রয়েছে ওই ম্যানুয়ালে। আর প্রশ্নটা উঠছে এখানেই। ভারতে বসবাসকারী কোনও মুসলমান যদি তাঁর জন্মের দিন ক্ষণ না জানেন বা ভুলে গিয়ে থাকেন, তাঁদের উৎসব বা রীতির কথা মনে করিয়ে এনপিআর-এ জন্মতথ্য নথিবব্ধ করার দায় কি নিতে চাইছে না কেন্দ্র? কেউ যদি অন্য ধর্মের উৎসব বা অনুষ্ঠানের কথা মনে করতে না পারেন, তা হলে কি ওই ব্যক্তির বিষয়ে ‘সম্পূর্ণ তথ্য’ থাকবে না এনপিআর-এ?
এনপিআর ম্যানুয়ালে এই সব উৎসবের কথাই বলা হয়েছে।
কলকাতা হাইকোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি এবং পশ্চিমবঙ্গের প্রথম লোকায়ুক্ত সমরেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায়: “ওই ম্যানুয়ালে যে ভাবে নথি সংগ্রহের কথা বলা রয়েছে, তার বাইরে গিয়ে কারও পক্ষে তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব নয়। ফলে কোনও মুসলমানের বাড়িতে গিয়ে যদি দেখা যায়, তিনি তার জন্মের বছর, মাস বা দিন মনে করতে পারছেন না, তাঁকে অন্য কোনও উৎসব বা অনুষ্ঠানের বিষয়টি মনে করানো হবে। তাঁর ধর্মের উৎসবের বিষয়টি মনে করানো হবে না। এটা কি ধর্মীয় বিভাজন নয়?” তিনি আরও বলেন, ‘‘দেশের কোনো ধর্ম নেই। রাষ্ট্র ধর্ম নিরপেক্ষ। এখানে যেন ফের একবার বিভাজন হয়ে যাচ্ছে। সংবিধানে জাত-পাতের বিষয়ে উল্লেখ নেই। এনপিআরের ম্যানুয়ালে কেন মুসলিম ধর্মের উৎসবের উল্লেখ থাকবে না? অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয়।’’
সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন (সিএএ)-এর প্রতিবাদে ইতিমধ্যেই বিরোধীরা এক জোট হতে শুরু করেছে। সংশোধিত এই আইন ভারতীয় সংবিধানবিরোধী বলেও দাবি করেছেন অনেকে। ‘ধর্মের’ ভিত্তিতে কোনও আইন কার্যকর করা ঠিক নয় বলে তোপ দাগতে শুরু করেছে বিরোধীরা। এ বার এনপিআর ম্যানুয়ালে মুসলিমদের উৎসব-রীতি বাদ পড়ায় ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত হানা হয়েছে বলে মনে করছে তারা।
এনপিআর-এর মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে ২১টি বিষয়ে জানতে চাওয়া হবে। সেখানে জন্ম সংক্রান্ত তথ্যও প্রয়োজন। কিন্তু অনেকেই ঠিক মতো তাঁদের জন্মের দিন ক্ষণ বলতে পারেন না। সে কারণে বড় কোনও ঘটনার কথা মনে করিয়ে তাঁদের জন্মের বিষয়টি জানতে চাওয়ার কথা বলা রয়েছে ম্যানুয়ালে। তাতে বলা হয়েছে, যদি কেউ জন্মের দিন এবং মাসের কথা মনে করতে না পারেন, তা হলে তার জন্মের বছর উল্লেখ করলেই হবে। কিছু ক্ষেত্রে ইংরেজি ক্যালেন্ডার অথবা বিভিন্ন ভাষাভাষীর বা সম্প্রদায়ের আলাদা ক্যালেন্ডারে উল্লেখ্যযোগ্য উৎসব এবং ঘটনা মনে করিয়েও জন্ম সংক্রান্ত তথ্যের বিষয়টি জানা যেতে পারে। এ বিষয়ে সবিস্তারে বলা হয়েছে ওই ম্যানুয়ালে। সেখানে উদাহরণ স্বরূপ বলা হয়েছে, অনেকেই জন্মের তারিখ বা মাস ভুলে যেতে পারেন। সে ক্ষেত্রে যদি তাঁর জন্মের বছর মনে থাকে, তা হলে তাঁকে জিজ্ঞেস করতে হবে, তিনি বর্ষা কালের আগে জন্মেছিলেন, না পরে? যদি জবাব হয়, বর্ষার আগে বা পরে জন্মেছিলেন, তা হলে তাঁর কাছে জানতে চাওয়া হবে, তাঁর কোনও উৎসবের দিন ক্ষণ মনে পড়ছে কি না। ওই উৎসবের তালিকায় নিউ ইয়ার, গুরু গোবিন্দ সিংহ জয়ন্তী, মকর সংক্রান্তি, শিবরাত্রি, ভাইফোঁটা, ছট পুজো, বুদ্ধ পূর্ণিমা, গুড ফ্রাইডের মতো বিভিন্ন ধর্মালম্বীদের উৎসব রয়েছে। তিনি যদি ওই তালিকার থাকা কোনও উৎসবের কথা মনে করতে পারেন, তা হলে ওই দিনটিকে উল্লেখ করে তার জন্মের মাস এবং দিন হিসাবে ধরে নিতে হবে।
গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ
এখানেই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে, অন্যান্য ধর্মীয় সম্প্রদায়ের বিভিন্ন উৎসবের কথা মনে করিয়ে তাঁর জন্মের বিষয়টি লিপিবদ্ধ করানোর কথা বলা হলেও, কেন মুসলমানদের কোনও উৎসব বা অনুষ্ঠানের বিষয়ের উল্লেখ নেই ম্যানুয়ালে? কোনও মুসলমানের কাছে তো, তাঁর ধর্মীয় উৎসবের বিষয়টি মনে থাকাই স্বাভাবিক। ফলে এই ক্ষেত্রে মুসলামানদের বঞ্চিত করা হচ্ছে বলেই মনে করছেন অনেকে। এরপিআর-এর সঙ্গে সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন (সিএএ) আইনের মিলও খুঁজে পাচ্ছেন কেউ কেউ। তাঁদের মতে ওই আইনে (২০১৪-র ৩১ ডিসেম্বর বা তার আগে) আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ থেকে যাঁরা এ দেশে এসেছেন, তাঁরা হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, পার্সি বা খ্রিস্টান হলে ভারতীয় নাগরিকত্ব পাবেন। মুসলমানদের ক্ষেত্রে সেই ‘সুবিধা’ দেওয়া হয়নি। সে ক্ষেত্রেও ধর্মীয় বিভাজন করা হয়েছে বলে মনে করছে বিরোধীরা।
তবে শুধু ধর্মীয় উৎসব বা রীতি নয়, জন্মের বছর মনে না পড়লে, কোনও ঘটনার কথাও মনে করানোর চেষ্টা করবেন তথ্য সংগ্রহে নিযুক্ত সরকারি কর্মীরা। যেমন বন্যা, ভূমিকম্প, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, ডান্ডি অভিযান (১৯৩০), স্বাধীনতার বছর (১৯৪৭), ভারত-চিন যুদ্ধ (১৯৬২)-সহ বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনার কথা বলতে পারলেও, সেই তথ্য জন্মসাল হিসাবে এনপিআর-এ লিপিবদ্ধ করা হবে।
বাড়ি বাড়ি গিয়ে এ ভাবেই তথ্য সংগ্রহ করবেন সরকারি আধিকারিকরা। —ফাইল চিত্র
২০১০ সালে প্রথম এনপিআর-এর মাধ্যমে ‘ডেটা’ সংগ্রহ করার প্রক্রিয়া শুরু হয়। তখন কেন্দ্রে ক্ষমতায় ছিল কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউএপিএ সরকার। ওই সময় যে ম্যানুয়াল বানানো হয়েছিল, সেখানে মুসলমানদের কোনও উৎসব-রীতির উল্লেখ ছিল না। ২০১৪ সালে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর, সেই অসম্পূর্ণ কাজ শেষ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। সেটা ২০১৫ সাল। পশ্চিমবঙ্গ-সহ বেশ কয়েকটি রাজ্যে এনপিআর-এর কাজ হয়েছে। ফের এক বার ২০২০ সালের এপ্রিল মাসে শুরু হতে চলেছে এনপিআর কর্মসূচি।
২০০৩ সালে অটলবিহারী বাজপেয়ী তখন প্রধানমন্ত্রী। সেই সরকারের আমলে নাগরিকত্ব আইন (১৯৫৫) সংশোধিত হয়। নতুন সংশোধিত আইনের বিধি তৈরির সময় ‘ন্যাশনাল আইডেন্টিটি কার্ড’, ‘এনপিআর’ এবং ‘এনআরআইসি’-র উল্লেখ করা হয়। বিধি তৈরি হওয়ার পর ‘ন্যাশনাল আইডেন্টিটি কার্ড’ তৈরিতে তৎপর হয় বাজপেয়ী সরকার। এনপিআর নিয়েও চলে চিন্তাভাবনা। কিন্তু ২০০৪-এর নির্বাচনে হেরে যায় বিজেপি তথা এনডিএ। কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ-১ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ফের এরপিআর প্রক্রিয়া শুরু হয়। দ্বিতীয় ইউপিএ জমানায় ১০ বছর আগে এনপিআর নিয়ে হইচই না হলেও, এখন পরিস্থিতি সম্পূর্ণ উল্টো। অসমে জাতীয় নাগরিকপঞ্জি (এনআরসি) কার্যকর হওয়ার পর প্রায় ১৯ লক্ষ মানুষের নাম বাদ গিয়েছে। গোটা দেশে যদি এনআরসি কার্যকর করে কেন্দ্র, তা হলে অনেকেই ‘নাগরিকত্ব’ হারানোর ভয় পাচ্ছেন। যে হেতু এনআরসি-র প্রাথমিক ধাপ হিসাবে এনপিআরকে ধরে নিচ্ছেন অনেকেই, তাই মুসলমানদের উৎসবের বিষয়টি বাদ যাওয়ায়, ওই সম্প্রদায়ের অনেকেই ভয় পাচ্ছেন। এনপিআর ম্যানুয়ালে মুসলমানদের উৎসব-রীতি বাদ দেওয়ায় বিরোধীরা নতুন করে সরকার বিরোধী ‘অস্ত্র’ পেলেন বলে মনে করছে ওয়াকিবহাল মহল। যদিও কংগ্রেসের পক্ষে এই বিষয়ে কিছু বলা বেশ অস্বস্তিদায়ক। কারণ, এই ম্যানুয়ালে মুসলমানদের উৎসব-রীতি বাদ পড়ার শুরু তো তাদের আমলেই।