জাতীয় নাগরিক পঞ্জি (এনআরসি) চূড়ান্ত না হওয়া পর্যন্ত অসমে ভোটগ্রহণ স্থগিত রাখা হোক— দু’দিন আগে কমিশনার, ডেপুটি কমিশনারদের কথাটা বলেছিলেন সাংসদ সুস্মিতা দেব। আজ নাগরিক অধিকার রক্ষা সমিতির (সিআরপিসি)-র সভায় ফের সেই দাবি তুললেন তিনি।
এমন বলার জন্য অবশ্য পরিস্থিতি তৈরি করে দিয়েছিলেন করিমগঞ্জের এআইইউডিএফ সাংসদ রাধেশ্যাম বিশ্বাস। রাধেশ্যামবাবু আক্ষেপ ব্যক্ত করে জানান— ২০১২ সালে অসম সরকার শ্বেতপত্র প্রকাশ করে জানিয়েছে, ২ লক্ষ ৩১ হাজার ৬৫৭ জনকে সন্দেহভাজন বা ডি ভোটার হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। তাদের ভোটাধিকার স্থগিত রাখা হয়। অর্থাৎ ভোটার তালিকায় এর বাইরে যাঁরা রয়েছেন, সবাই সন্দেহের উর্ধ্বে। কিন্তু এখনও দিল্লিতে তাঁদের ‘বাংলাদেশিদের ভোটে নির্বাচিত’ বলে বিদ্রুপ করা হয়।
সেই সূত্রেই পরবর্তী বক্তা শিলচরের কংগ্রেস সাংসদ সুস্মিতা দেব দাবি করেন, আগে বাংলাদেশিদের খুঁজে বের করা হোক। এর পর হোক অসমে লোকসভার ভোট। তাঁর যুক্তি, ভোটার তালিকায় বাংলাদেশি রয়ে গিয়েছে বলে শোরগোল তোলা হবে, আবার তাঁদের ভোটেই কেন্দ্রে-রাজ্যে সরকার গঠন হবে, সাংসদ-বিধায়ক নির্বাচিত হবেন, এ কেমন কথা!
সুস্মিতাদেবী সংবিধানের কথা টেনে বলেন, ‘‘কোনও বিদেশি এখানকার কোনও নির্বাচনে ভোট দিতে পারেন না। ফলে রাষ্ট্র যাঁদের ভোটার হিসেবে স্বীকৃতি দেয়, তাঁরা ভারতীয়ই। কিন্তু অসমের বাঙালিদের ক্ষেত্রে এ কথা কেউ মানতে চান না। ভোটের সময় সবাই ভারতীয়, আর বাকি সময় বাংলাদেশি বলেই সন্দেহ করা হয়।’’ তাই তাঁর জোরালো দাবি, এনআরসি তৈরির মাধ্যমে বাংলাদেশি অপবাদের নিষ্পত্তি হোক। এর পরই হোক ভোটগ্রহণ।
এটা কি তাঁর ব্যক্তিগত অভিমত? উপস্থিত জনতার মনের প্রশ্ন আঁচ করতে পেরে সুস্মিতাদেবী নিজেই বলেন, ‘‘রাজনীতিবিদ বা জনপ্রতিনিধিদের ব্যক্তিগত অভিমত বলে কিছু হতে পারে না।’’ তাঁর নির্বাচনী কেন্দ্রের মানুষের অভিমত হিসেবেই তিনি তা উত্থাপন করবেন বলে সভায় জানিয়েছেন। তিনি জানান, প্রথমে গুয়াহাটি ও দিল্লিতে দলের নেতাদের কথাটি বোঝানোর চেষ্টা করবেন। পরে যাবেন নির্বাচন কমিশনের কাছে। তাঁর কথায়, ‘‘অসমকে বাদ দিয়ে লোকসভা নির্বাচন করানো মোটেও নতুন কথা নয়। আগেও ১৯৮৪ সালে সারা দেশে যখন ভোট হচ্ছিল, অসমে তখন হয়নি।’’ কিন্তু কংগ্রেস নেতা তরুণ গগৈ কী বলছেন? প্রশ্নটা নিজেই তুলে শিলচরের সাংসদ বলেন, ‘‘তরুণ গগৈ বা প্রফুল্ল মহন্ত কী বললেন, এতে তা বিচার্য নয়। দেখতে হবে নরেন্দ্র মোদী কী বলেন, বিজেপি কী ভাবে।’’ তাই নাগরিকত্বের জন্য মোদীর উপর চাপ সৃষ্টির পরামর্শ দেন তিনি।
সুস্মিতাদেবী দু’দিন ধরে বিভিন্ন জায়গায় যে কথা বলছিলেন, আজও তা উল্লেখ করেন। তিনি জানান, নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলটি বর্তমানে যে অবস্থায় রয়েছে, তাকে আইনে পরিণত করতে বিজেপির কোনও সমস্যা হবে না। যৌথ সংসদীয় কমিটি বিরূপ মন্তব্য করলেও কিছু যাবে-আসবে না। এমনকী, রাজ্যসভায় এটি পাশ হবে কি না, সেই প্রশ্নও অবান্তর বলেই জানান তিনি। সুস্মিতাদেবীর কথায়, ‘‘এই ধরনের সংশোধনীর জন্য সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতাই যথেষ্ট।’’ এরপরই তাঁর মূল কথা, এই বিল আইনে পরিণত হলেও অসমের বাঙালিদের কোনও লাভ হবে না। উদ্বাস্তুরা শুধুই নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে পারবেন। মিলবে কি না তা ঠিক হবে প্রচলিত আইন ও সেই সময়কার কেন্দ্রীয় সরকারের মর্জির উপর।
সংশোধনী বিলের আরও একটি ত্রুটির কথা উল্লেখ করেন সিআরপিসি-র মুখ্য উপদেষ্টা হাফিজ রশিদ আহমদ চৌধুরী। তিনি জানান, ভারতীয় সংবিধানে ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকত্বের কোনও সংস্থান নেই। ফলে সংশোধনীটি পাশ হলেও কেউ আদালতে গেলে আইএমডিটি-র মতো এটিও বাতিল হয়ে যাবে। তাই বিজেপির বিল পাশের উদ্দেশ্য ও আন্তরিকতা নিয়েই প্রশ্ন তোলেন তিনি। তাঁর পরামর্শ, ‘‘কোনও ধর্মের উল্লেখ না করে দেশভাগের শিকার মানুষদের নাগরিকত্ব প্রদানের কথা বলা হোক। সে ক্ষেত্রে ধর্মীয় নির্যাতনের শিকার মানুষরাই নাগরিকত্ব পাবে। সাপও মরবে, লাঠিও ভাঙবে না।’’
সিআরপিসি-র আজকের সভায় সম-মানসিকতার ১৫টি সংগঠন তাদের পাশে থাকার অঙ্গীকার করে। সব শেষে সিদ্ধান্ত হয়, ওই সব সংগঠনগুলিকে নিয়ে একটি সমন্বয় কমিটি তৈরি করা হবে। এই কমিটির নেতৃত্বেই নাগরিকত্ব নিয়ে আন্দোলন সংগঠিত হবে। তাঁরা জাতীয় স্তরে নিজেদের বক্তব্য তুলে ধরবেন। দেশভাগের বলি উদ্বাস্তুদের নাগরিকত্ব দাবি করবেন।
আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য তপোধীর ভট্টাচার্য, দুই প্রাক্তন বিধায়ক আতাউর রহমান মাঝারভুঁইঞা ও মোস্তাফা শহিদুল ইসলাম, সারিমুল হক, মনীন্দ্র রায়, সুব্রত পালও সভায় বক্তব্য রাখেন। পৌরোহিত্য করেন সিআরপিসির কেন্দ্রীয় সভাপতি নৃপেন্দ্রচন্দ্র সাহা।