প্রতীকী ছবি।
যেন ‘সোনার কেল্লায়’ মুকুলকে বলা সেই বিখ্যাত সংলাপ: ‘ভ্যানিশ!’
গত বছর প্রকাশিত নতুন শিক্ষা নীতির খসড়াতেও স্পষ্ট লেখা ছিল, ধ্রুপদী ভারতীয় ভাষা এবং ইংরেজির পাশাপাশি সেকেন্ডারি স্তরে যে সমস্ত বিদেশি ভাষা শেখার সুযোগ পড়ুয়াদের সামনে খুলে দেওয়া হবে, তার মধ্যে রয়েছে কোরিয়ান, ম্যান্ডারিন, জাপানি, তাই, ফরাসি, জার্মান, স্প্যানিশ, রাশিয়ানও। যাতে বিশ্বের বিভিন্ন ভাষা এবং সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হতে পারেন পড়ুয়ারা। পূরণ করতে পারেন নিজেদের স্বপ্ন। মন্ত্রিসভার সবুজ সংকেত মেলার পরে যে নতুন শিক্ষা নীতি শিক্ষা মন্ত্রকের ওয়েবসাইটে তুলে দেওয়া হয়েছে, প্রায় অবিকল সেই কথা লেখা সেখানেও। শুধু ভাষার তালিকায় চিন উধাও! তার জায়গায় এসেছে পর্তুগিজ।
তালিকা থেকে ম্যান্ডারিন ভাষা ছাঁটাইয়ের কারণ কী, তা স্পষ্ট করেনি কেন্দ্র। কিন্তু যে ভাবে একেবারে শেষ পাকে তা বাদ পড়েছে, তাতে স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন, লাদাখে পড়শি মুলুকের সঙ্গে সীমান্ত সংঘাতের জেরেই কি কোপ পড়ল তাদের ভাষায়? অনেকেরই জিজ্ঞাসা, সীমান্তে ‘সাময়িক’ সামরিক উত্তেজনার ছায়া দীর্ঘ মেয়াদি শিক্ষা নীতিতে পড়বে কেন? কাল যদি রাশিয়া কিংবা ব্রাজিলের সঙ্গে মতবিরোধ ঘটে, তবে কি রুশ ব্যালে কিংবা সাম্বা ফুটবল দেখা বন্ধ করে দেব আমরা? ব্রিটেনের সঙ্গে সম্পর্ক বিগড়ালে, বয়কট করব ইংরেজি?
বাদ দেওয়ার এই সিদ্ধান্তকে নিছক তামাশা মনে করছেন জেএনইউয়ের চিনা ভাষার অধ্যাপক হেমন্ত আদলাখা। তাঁর বক্তব্য, “চিন শুধু ভারতের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী নয়, বিশ্ব অর্থনীতির অন্যতম ভরকেন্দ্র। ভারতের সঙ্গে তাদের বাণিজ্যের অঙ্কও বিপুল। এই পরিস্থিতিতে যদি স্কুল-পড়ুয়াদের একাংশ চিনা ভাষা শিখে রাখে, তবে দেশের পক্ষেও তা সুবিধাজনক।” মূল চিনা ভূখণ্ডে যে ম্যান্ডারিন ভাষার চল, ফি বছর তার ডিগ্রি পাশ করেন অন্তত ৩০ হাজার দক্ষিণ কোরীয়, জাপানি পড়ুয়া। শুধু টোকিয়োতে ওই ভাষা জানা লোকের সংখ্যা ১০ লক্ষ। ম্যান্ডারিন পড়ুয়ার সংখ্যা যথেষ্ট বেশি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সমস্ত দেশ, অস্ট্রেলিয়া, ইউরোপ এবং আমেরিকায়। দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান থেকে প্রতি বছর অনেকে ম্যান্ডারিন পড়তে আসেন জেএনইউ-তেও। কিন্তু ভারত থেকে চিনে পড়তে যাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা নগণ্য।
১৯৬২ সালে চিনের সঙ্গে যুদ্ধের ছায়া থেকে বেরিয়ে এসে যখন দু’দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক ফের শুরু হয়, তার পর থেকে ভারত থেকে সরকারি বৃত্তিতে চিনে ম্যান্ডারিন পড়তে যাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা তা-ও কিছুটা বাড়ছিল। কিন্তু প্রথমে ডোকলাম এবং তার পরে লাদাখে প্রেসিডেন্ট শি চিনফিংয়ের দেশের সঙ্গে সম্পর্ক তেতো হওয়ার পরে তার আঁচ পড়ছে ভাষা শিক্ষাতেও। হেমন্তের হিসেব অনুযায়ী, “২০১৪-১৫ সাল পর্যন্তও প্রতি বছর ৩০-৪০ জন পড়ুয়া সরকারি পড়ুয়া পাল্টাপাল্টি (স্টুডেন্ট এক্সচেঞ্জ) প্রকল্পে চিনে পড়তে যাওয়ার সুযোগ পেতেন। গত বছর সেই সংখ্যা নেমে এসেছে একে!”
আন্তর্জাতিক অর্থ ভাণ্ডারের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম চার মাসে ভারত থেকে চিনে রফতানির অঙ্ক ১৮ হাজার কোটি ডলারের বেশি। এ দেশের বহু প্রথম সারির স্টার্ট-আপে লগ্নি করেছে চিন। টাকা ঢেলেছে পরিকাঠামোয়। কিন্তু সীমান্ত সংঘাতের কারণে ইতিমধ্যেই বেশ কিছু চিনা অ্যাপ (মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন) ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে দিল্লি। কড়াকড়ির দেওয়াল তোলা হচ্ছে এ দেশের সরকারি বরাতে চিনা সংস্থার যোগ দেওয়া, এমনকি সে দেশ থেকে বিভিন্ন যন্ত্র ও যন্ত্রাংশ আমদানির বিষয়েও।
অনেকেরই প্রশ্ন, এ ভাবে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক আরও তেতো হবে না কি? তা ছাড়া, সম্পর্ক মেরামতের জন্যও তো আগে কথা বলা জরুরি। পারস্পরিক ভাষা জানা থাকলে, সেখানে বাড়তি সুবিধা অনেকখানি। যেমন ইন্দো-তিব্বতি সীমান্ত পুলিশের অফিসারদেরই ম্যান্ডারিন শেখানোর রেওয়াজ আছে। যাতে সীমান্তে উল্টো পক্ষের সঙ্গে ভুল বোঝাবুঝি তৈরি হওয়ার আগেই কথা বলে নিতে পারে তারা।
চিনা ভাষার এক অধ্যাপক অবশ্য মনে করেন, “এই সিদ্ধান্ত সাময়িক। বর্তমান পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে নেওয়া।” তাই সম্পর্ক শোধরালে, সিদ্ধান্ত বদলের বিষয়ে আশাবাদী তিনি। তেমনই ওই ভাষার আর এক অধ্যাপক আবার এ বিষয়ে সংশয়ী। তাঁর খটকা, “সিদ্ধান্ত সাময়িক হলে, তা শিক্ষা নীতিতে প্রতিফলিত হত কি?”