হরেক সমস্যা ঘিরেছে লালা টাউন কমিটির পুরনেত্রী বিজয়লক্ষ্মী দেবনাথকে। বোর্ড গঠন নিয়ে কংগ্রেস–বিজেপির টানাপড়েনের মধ্যেও পুরনেত্রীর কুর্সি দখল করেন দেবনাথ।
কংগ্রেস নেতা গৌতম রায়ের নির্বাচন কেন্দ্র লালা শহরের টাউন কমিটির ক্ষমতা বিজেপির হাত থেকে বাঁচাতে নির্দল বিজয়লক্ষ্মীদেবীকে পুরনেত্রীর আসন ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিল কংগ্রেস। এ নিয়ে কংগ্রেস সদস্যদের মধ্যে ক্ষোভ রয়েছে। নির্দল সদস্যকে কংগ্রেসি পুরবোর্ডের প্রধান করা নিয়ে গৌতমবাবুর সিদ্ধান্তে অনেকেই অখুশি। অন্য দিকে একক সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়েও ক্ষমতার বাইরে থাকায় বিজেপি সদস্যরাও বোর্ডের ত্রুটি খুঁজতে তৎপর। এ সবের জেরে কার্যত ঘরে-বাইরে লড়তে হচ্ছে বিজয়লক্ষ্মীদেবীকে। এ সবের আঁচ পাচ্ছেন সাধারণ মানুষও।
১৯৭২ সালে গ্রামীণ এলাকা লালাকে (বাজার ) শহরের মর্যাদা দিয়েছিল রাজ্য সরকার। আজও লালার গায়ে গ্রামের ‘গন্ধ’ লেগে রয়েছে। বরাক উপত্যকার হাইলাকান্দি জেলার প্রান্তিক শহর লালা। অতীতে তার নামকরণ হয়েছিল ‘কুকী’ ভাষার শব্দ থেকে। কুকী ভাষায় ‘লা-লা’ শব্দের অর্থ উঁচুনীচু। আগে এই এলাকা ছিল তেমনই। বর্তমানে ৪৩ বছর পুরনো এই শহরে বয়সের ছাপ লেগেছে। উন্নয়নের অভাবে ধুঁকছে এই প্রান্তিক শহর। নিকাশি ব্যবস্থা বেহাল। বৃষ্টি হলেই জমছে জল। অন্য দিকে রয়েছে পানীয় জলের হাহাকার। বছর চারেক আগে লালা শহরে ৫ কোটি টাকা খরচে জল সরবরাহ প্রকল্প স্থাপন করা হয়েছিল। সেই প্রকল্প থেকে নিয়মিত পানীয় জল সরবরাহ করার স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন তৎকালীন মন্ত্রী গৌতম রায় ও দীনেশ প্রসাদ গয়ালা। সেই প্রকল্প থেকে ঘরে ঘরে পানীয় জল পৌঁছে দেওয়ার জন্য বাড়ি বাড়ি পাইপ লাইনে সংযোগ দেওয়া হয়। সে জন্য নাগরিকদের প্রায় ৪ হাজার টাকা করে দিতে হয়েছিল। আনুষ্ঠানিক ভাবে প্রকল্প চালুও হয়েছিল । কিন্তু ওইটুকুই। তার পর আর এক বিন্দু জলও কেউ পাননি। বাড়িতে জলের সংযোগের জন্য যাঁরা টাকা দিয়েছিলেন, তাঁরা এখন তা ফেরত চান।
ওই জল প্রকল্পের অফিস এখন বাদুড়, চামচিকের ‘ঘরবাড়ি’!
লালার ব্যবসায়ী তথা বিজেপি নেতা গোবিন্দলাল চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘বাড়িতে সংযোগ দেওয়ার বদলে নেওয়া টাকা কোথায় গেল তা তদন্ত করে দেখা হোক।’’ নবগঠিত লালা টাউন কমিটির বিরোধী বিজেপি দলনেতা তপন নাথের বক্তব্য, ‘‘আমরা এ সব বড় কেলেঙ্কারির তদন্ত করতে চাই।’’ লালায় জনস্বাস্থ্য কারিগরী বিভাগের জল প্রকল্পও রয়েছে। যদিও জল সরবরাহ অনিয়মিত। কার্যত ১২ মাসই পানীয় জলের সঙ্কটে থাকেন সাধারণ মানুষ। লালার নালা-নর্দমা, সড়কেরও বেহাল দশা। শহরের সেন্ট্রাল রোডের ব্যবসায়ীরা বলেন, ‘‘পুরকর দেওয়া হচ্ছে কিন্তু পরিষেবা মিলছে না।’’
শহরের এই পরিস্থিতির জন্য নাগরিকদের আঙুল উঠছে মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈয়ের উপদেষ্টা বিধায়ক গৌতম রায়ের দিকে। তাঁদের অভিযোগ, শহরের রাস্তা, জল প্রকল্প নির্মাণের ঠিকাদারি বরাত পান গৌতমবাবুর ঘনিষ্ঠ লোকেরাই। জেলার বাইরে থাকায় এ নিয়ে গৌতমবাবুর সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি। এলাকাবাসী জানান, লালা টাউন কমিটি প্রাণকৃষ্ণ রোডে ৪৯ লক্ষ টাকা খরচে পাকা রাস্তা তৈরি করেছিল। কিন্তু খারাপ নির্মাণকাজের জন্য কয়েক দিনেই সেটি ভেঙেচুরে যায়। জোর বাতাসে বালি ওড়ে। বৃষ্টিতে জমে কাদা। প্রাণকৃষ্ণ রোডের বাসিন্দাদের বক্তব্য— প্রতি দিন তাঁরা ভোগান্তির মুখে পড়ছেন। সঙ্গে রয়েছে তীব্র যানজট। রিকশা, অটোর জন্য পরিকল্পিত পার্কিংয়ের জায়গা না থাকায় যানজটে নাকাল লালার বাসিন্দারা। ট্রাফিক ব্যবস্থাও এমন খারাপ যে, যান নিয়ন্ত্রণের কাজ করতে হচ্ছে গৌতম রায়ের বেতন পাওয়া সাদা পোশাকের ব্যাক্তিগত নিরাপত্তাকর্মীদের। শহর থেকে সরে গিয়েছে দমকলও।
৪৩ বছরে লালার সমস্যা ক্রমেই বেড়েছে। কিন্তু সমাধান মেলেনি কিছুরই। আগে মাত্র ৪টি ওয়ার্ড ছিল শহরে। এখন তার সংখ্যা ১০। শহরটি যেন অকালে অনেক বয়স্ক হয়ে গিয়েছে। এই শহরের দায়িত্ব নিয়েছেন প্রৌঢ়া বিজয়লক্ষ্মীদেবী। সহ-পুরনেত্রী নিয়তি বন্দ্যোপাধ্যায়। বিজয়লক্ষ্মীদেবী জানিয়েছেন, গৌতমবাবুর সাহায্যে তিনি সব সমস্যার সমাধান করতে পারবেন। লালার মানুষ অবশ্য বর্তমান বোর্ডের ভবিষ্যৎ নিয়ে সন্দিহান। তাঁদের বক্তব্য, বিজয়লক্ষ্মীদেবী নন, লালার ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করবেন অন্য কেউ-ই।