এই ককপিট দেখে তদন্তকারীদের অনুমান, শেষ মুহূর্তে ফের ওড়ার চেষ্টা করেন পাইলট। নিজস্ব চিত্র
শেষ মুহূর্তে বাঁচার প্রাণপণ চেষ্টা করেছিলেন তাঁরা। বুঝতে পেরেছিলেন, রানওয়ের মধ্যে বিমানকে আর দাঁড় করানো যাবে না। তখন দু’টি ইঞ্জিনের পূর্ণ শক্তিকে কাজে লাগিয়ে কোঝিকোড়ের রানওয়ে ছেড়ে আবার আকাশে উড়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন অভিশপ্ত বিমানের দুই পাইলট।
কেরলের কোঝিকোড়ে শুক্রবার সন্ধ্যায় ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনার তদন্তে নেমে এয়ারক্র্যাফ্ট অ্যাক্সিডেন্ট ইনভেস্টিগেশন বুরো (এএআইবি)-র কর্তাদের হাতে প্রাথমিক ভাবে এই তথ্য উঠে এসেছে। ভেঙে পড়া ককপিট দেখে তাঁদের মনে হয়েছে, শেষ মুহূর্তে ব্রেক ছেড়ে দিয়ে আকাশে ওড়ার লিভারকে সর্বশক্তি দিয়ে কাজে লাগানোর চেষ্টা করেছিলেন দুই পাইলট। অকেজো করে রেখেছিলেন ব্রেক। আনন্দবাজারের হাতে আসা একটি ভিডিয়োয় দেখা গিয়েছে, ভেঙে পড়া বিমানের কাছে তদন্তরত দুই অফিসার তথ্যপ্রমাণ দেখে আলোচনা করছেন। এক অফিসার আর এক জনকে বলছেন, “হি ওয়াজ এগেন ট্রাইং টু টেক অফ।”
ঠিক একই ভাবে, ১০ বছর আগে মেঙ্গালুরু বিমানবন্দরেও শেষ মুহূর্তে আকাশে ওড়ার চেষ্টা করেছিলেন এয়ার ইন্ডিয়া এক্সপ্রেসের দুই পাইলট। শুক্রবারের দুর্ঘটনার পরে উঠতে থাকা প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য কোঝিকোড়ে ভেঙে পড়া বিমানের দুই পাইলট আর বেঁচে নেই। বিমানের ব্ল্যাক বক্সই প্রধান ভরসা। তা এখন তদন্তকারীদের কাছে। চলছে ডি-কোড করার কাজ। তার ভিতরে ফ্লাইট ডেটা ও ককপিট ভয়েস রেকর্ডারে যে তথ্য এবং কথোপকথন রয়েছে, তা থেকে দুর্ঘটনার কারণ সম্পর্কে অনেকটাই স্বচ্ছ ধারণা তৈরি হওয়ার কথা।
প্রাথমিক ভাবে আরও একটি বিষয়ে বিশেষজ্ঞেরা নিশ্চিত— রানওয়ের যেখানে মাটি ছোঁয়ার কথা ছিল, সেই জায়গা ছাড়িয়ে গিয়ে বিমানটি মাটি ছোঁয় এবং সেই সময়ে বিমানের গতিও স্বাভাবিকের থেকে বেশি ছিল। কিন্তু, কেন? সেই প্রশ্নই এখন সবচেয়ে বেশি ভাবাচ্ছে তদন্তকারীদের।
বিমান মন্ত্রকের একটি সূত্র জানাচ্ছে, রানওয়ের পূর্ব প্রান্ত দিয়ে নামতে গিয়েও যখন ক্যাপ্টেন দীপক বসন্ত শাঠে নামতে পারেননি, তখন তিনি এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল (এটিসি)-র কাছ থেকে ১০ হাজার ফুট পর্যন্ত উঠে যাওয়ার অনুমতি নিয়েছিলেন। কিন্তু, প্রায় আট হাজার ফুট উপরে গিয়ে তিনি সিদ্ধান্ত বদলে ফেলেন। জানান, তিনি রানওয়ের পশ্চিম প্রান্ত থেকে নামতে চান। প্রশ্ন উঠেছে, কেন এত তাড়াতাড়ি সিদ্ধান্ত বদলে ফেলেছিলেন শাঠে? প্রায় ১০ মিনিট ওড়ার পরে তিনি নেমে আসেন রানওয়ের পশ্চিম প্রান্তে। অনুমান, ওই সময়টুকু জ্বালানি পুড়িয়ে বিমানের ওজন কমাতে চেয়েছিলেন পাইলট।
প্রশ্ন, কোঝিকোড় টেবলটপ রানওয়ের উপরে কি এতটাই রবার জমে ছিল যে ওই বৃষ্টির মধ্যে ব্রেক কাজ করেনি? অভিজ্ঞ পাইলটদের কথায়, “প্রতিবার যখন ঘণ্টায় প্রায় ২৫০ কিলোমিটার বেগে বিমান রানওয়ের মাটি ছোঁয়, তখন রানওয়ের সঙ্গে প্রবল ঘর্ষণে চাকা থেকে কিছুটা রবার রানওয়েতে পড়ে যায়। প্রতিটি বিমানবন্দরেই কিছু সময় অন্তর সেই রবার পরিষ্কার করে নিতে হয়। পরীক্ষা করে দেখতে হয়, রানওয়েতে ব্রেক কষলে ধরার মতো ক্ষমতা আছে কিনা। একে বিমানের পরিভাষায় ফ্রিকশন টেস্ট বলে।” ডিরেক্টরেট জেনারেল অব সিভিল অ্যাভিয়েশন-এর একটি সূত্র জানাচ্ছে, জুলাইয়ের শেষে কোঝিকোড় রানওয়ে পর্যবেক্ষণ করে ওই রবার জমে থাকার প্রমাণ পাওয়া যায়। অগস্টের গোড়াতেই তা পরিষ্কার করে ডিজিসিএ-কে রিপোর্ট পাঠানো হয়েছিল বলে একটি সূত্র জানিয়েছে।
বিশেষজ্ঞেরা জানান, বিমান মাটি ছোঁয়ার পরে তিন ভাবে ব্রেক ব্যবহার করা হয়। এক, ডানার উপরে এক ধরনের ফ্লিপার থাকে। সেগুলি খুলে দিলে সেটিতে হাওয়ার ধাক্কা লেগে গতি কমতে থাকে। একে ‘স্পয়লার’ বলে। দুই, সাধারণত ইঞ্জিনের হাওয়ার ধাক্কা পিছন থেকে বার হয়। নামার পরে সেটি উল্টো দিকে ঘুরিয়ে দেওয়া হয়। হাওয়ার ধাক্কা তখন ইঞ্জিনের সামনে থেকে বার হতে থাকে। তাতেও কমতে থাকে বিমানের গতি। শেষ হচ্ছে ল্যান্ডিং গিয়ার বা পিছনের চাকার সঙ্গে থাকা ব্রেক ব্যবহার।
এই সব ঠিকঠাক কাজ করলে কোনও ভাবেই দুর্ঘটনা ঘটার কারণ থাকতে পারে না বলে মনে করছেন তদন্তকারীরা। একটি সূত্র থেকে এমনও অভিযোগ, ল্যান্ডিং গিয়ারের যান্ত্রিক ত্রুটির জন্য সমস্যা হয়ে থাকতে পারে। কিন্তু প্রথম বার পূর্ব প্রান্ত থেকে নামার সময়েই তা নজরে পড়ার কথা। সে ক্ষেত্রে ককপিটে অ্যালার্মও পাওয়ার কথা পাইলটের। এবং সেটা পেলে তা এটিসিকে জানানোর কথা। বাস্তবে সে রকম কিছু হয়নি। বিশেষজ্ঞদের মতে, ওই রকম প্রবল বৃষ্টির মধ্যে টেবলটপ রানওয়েতে যান্ত্রিক ত্রুটি নিয়ে নামার অর্থ আত্মহত্যা করা। সেই রকম কিছু হলে শাঠে কাছের কোচি বা অন্য বিমানবন্দরে চলে যেতেন। কী কারণে ওঁরা ঝুঁকি নিয়েও নেমেছিলেন, সেই প্রশ্নের উত্তরই খুঁজছেন তদন্তকারীরা।