অভ্রপ্রতিম মান্না
অভ্রপ্রতিম মান্না (১৯)
কম্পিউটার সায়েন্স, প্রথম বর্ষ, চেন্নাই এসআরএম বিশ্ববিদ্যালয়
একটা সময়ে মাথা কাজ করছিল না। কী যে করব কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। ২ ডিসেম্বর। তখনও জোরে বৃষ্টি পড়ছে।
ভিজে হাফ-প্যান্ট পরে ততক্ষণে ২০ ঘন্টা কাটিয়ে দিয়েছি। চেন্নাই বিমানবন্দরের বাইরে বসে। হস্টেল থেকে বেরিয়ে এসেছি গতকাল সন্ধ্যা সাতটায়। হাওয়াই চটি, হাফ-প্যান্ট, টি-শার্ট। পিঠে ব্যাগ। মাথার উপরে ধরা স্যুটকেস। অঝোর ধারে বৃষ্টি পড়ে যাচ্ছে তখনও। সাত তলা থেকে নেমে মাটিতে পা দিতেই জল উঠে গেল পেটের উপরে। হাফ-প্যান্ট, টি-শার্ট দুই ভিজে এক সা। সঙ্গে পিঠের ব্যাগ, স্যুটকেসও।
নীচে নেমে দু’ঘণ্টা কিছু পাইনি। চার দিকে অন্ধকার। রাস্তার আলোও জ্বলছে না। জল ঠেলে ঠেলে এগোতে গিয়ে হুড়মুড় করে জলের মধ্যে পড়ে গিয়েছি কয়েকবার। হাঁটু ছড়ে গিয়েছে। রাস্তায় এক পুলিশ অফিসারের সঙ্গে দেখা। বললেন, সোজা বিমানবন্দর যাওয়ার রাস্তায় সেতুর উপরে ১২ ফুট জল। ও দিক দিয়ে যাওয়া যাবে না। অনেক চেষ্টা করে একটি অটোকে ধরে ২ হাজার টাকা দিয়ে ১৫ মিনিটের রাস্তা এসেছি দু’ঘন্টায়। হস্টেল থেকে বিমানবন্দর, গোটা চেন্নাই ঘুরে। ভাগ্যিস মঙ্গলবার বেরিয়ে পড়েছিলাম। আমাদের উড়ান ছিল বুধবার দুপুরে, স্পাইসজেটের। কিন্তু, শুনলাম হস্টেল থেকে এক দল যাচ্ছে বিমানবন্দরে। ওরা ভোরের ইন্ডিগোর উড়ান ধরবে। সবার গন্তব্যই কলকাতা। ভাবলাম, ওদের সঙ্গেই চলে যাই। সেটা না ভাবলে, ও ভাবে তড়িঘড়ি সাত তলা থেকে নেমে না আসলে, আজও বোধহয় আমি আটকে থাকতাম সাত তলার ঘরে। আর বাবা-মা এখানে টেনশন করে করে যে কী করত কে জানে!
মঙ্গলবার রাত সাড়ে এগারোটায় বিমানবন্দর পৌঁছেই প্রথমে ভোরের ইন্ডিগোর উড়ানের টিকিট কাটলাম। এক একটা টিকিটের দাম তখন প্রায় ১৫ হাজার টাকা। একটু পরেই শুনলাম, সকালের ইন্ডিগো অনিশ্চিত। আমাদের দুপুরে স্পাইসও উড়বে না। চুপ করে আমরা পাঁচজন বিমানবন্দরের বাইরে বসে রাতটুকু কাটিয়ে দিয়েছিলাম। সকাল হতেই জানা গেল রানওয়েতে জল জমে গিয়েছে। আগামী তিন দিন কোনও বিমানই উড়বে না। ততক্ষণে ফোনের ব্যাটারি শেষ। বন্ধুর ফোন থেকে কোনওমতে কলকাতায় বাবাকে ফোন করলাম। বাবা-র অনেক চেনাজানা আছে চেন্নাইয়ে। বললাম, একমাত্র বাঁচার উপায় চেন্নাই থেকে বেঙ্গালুরু চলে যেতে হবে। সেখান থেকে বিমান ধরে কলকাতায়। বাবা বলল, গাড়ির ব্যবস্থা করে জানাবে।
কিন্তু, কোথায় গাড়ি? কোন দিক থেকে গাড়ি আসবে? বিমানবন্দরের সামনের রাস্তায় তখন হাঁটু জল। পাশ থেকে কে একজন বলল, কোনও ভাবে কোয়েমবেরু বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত পৌঁছতে পারলে সেখান থেকে বেঙ্গালুরুর বাস ছাড়ছে। আমরা নিজেদের মধ্যে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলাম। ঠিক করলাম, যা থাকে কপালে কোয়েমবেরু পৌঁছতেই হবে। কাছেই আলান্দুর মেট্রো স্টেশন। শুনলাম মেট্রো চলছে। মেট্রো করে কোয়েমবেরু পৌঁছে যেতে পারব। আবার মাথায় স্যুটকেস নিয়ে নেমে পড়লাম হাঁটু জল রাস্তায়। তখনও বৃষ্টি পড়ে চলেছে। মেট্রো স্টেশনে গিয়ে টিকিটও কেটেছিলাম। কিন্তু, সেখানে তখন পিল পিল করে মানুষ ঢুকছে। সবারই গন্তব্য কোয়েমবেরু। অসহায় লাগছিল। কী করে এ ভাবে কোয়েমবেরু পৌঁছোব। সেখান থেকে কি আদৌ বাস পাব? আবার নিজেদের মধ্যে কথা বললাম। মেট্রোর টিকিট বিক্রি করে দিলাম, স্টেশনে নেমে টিকিটের বিশাল লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা একটি পরিবারের কাছে। ফিরে এলাম বিমানবন্দরে। আর তখনই বিমানবন্দরের বাইরে বসে আচমকা মাথাটা ফাঁকা হয়ে গেল। কী করব? কী করে বেঙ্গালুরু পৌঁছব?
বাবা-র সঙ্গে আবার যোগাযোগ হল। বাবা বলল, কোনও মতে একটি গাড়ির ব্যবস্থা করা গিয়েছে। সেই গাড়ি আমাদের জন্য রামচন্দ্র মেডিক্যাল কলেজের সামনে দাঁড়িয়ে। কিন্তু, বিমানবন্দর থেকে সেই দিকে যাওয়ার রাস্তা তো বন্ধ! যাব কী করে! বুধবার দুপুরে এ সব নিয়ে যখন মাথা খারাপ অবস্থা তখন দেখলাম, বিমানবন্দর থেকে বাস ছাড়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। শুনলাম, বিমান ধরার জন্য যে ভাবে টার্মিনালের ভিতরে ঢুকে নিরাপত্তা এলাকা পেরিয়ে তার পরে বিমানে ওঠা যায়, তেমনই বাসে উঠতে গেলেও সঙ্গে বিমানের টিকিট থাকতে হবে। সেই নিরাপত্তা এলাকা পেরিয়ে গিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে বাসে উঠতে হবে। বাক্য ব্যয় না করে সেই লাইনে দাঁড়িয়ে গেলাম। বলা হয়নি, মঙ্গলবার সন্ধ্যার পর থেকে তখনও পর্যন্ত কিন্তু আমাদের কোনও খাবার জোটেনি। ওই প্রথম বিমানবন্দরের ভিতরের একটি দোকান থেকে কিছু খাবার কিনে খেলাম।
সন্ধ্যার পরে প্রায় যখন লাইনের মুখে পৌঁছেছি, তখন শুনলাম বাস আর যাবে না। প্রথম দিকে দু’টি বাস কিছুটা গিয়ে ফিরে এসেছে। বেঙ্গালুরুর রাস্তায় এতটাই জল যে বড় বাস পর্যন্ত যেতে পারছে না। চোখে তখন প্রায় জল চলে আসার মতো অবস্থা। শেষে বিমানবন্দর থেকে বলা হল, কোয়েমবেরু পৌঁছে দেওয়া হবে বাসে। সেখান থেকে রাতে বেঙ্গালুরুর বাস ছাড়বে। কোয়েমবেরু পৌঁছে দেখলাম, বেঙ্গালুরুর বাস ধরার জন্য কাতারে কাতারে লোক অপেক্ষা করছে। যাঁরা ট্রেন ধরতে পারেননি তাঁরাও এসেছেন। ততক্ষণে ট্রেনও বাতিল হয়ে গিয়েছে। আমাদের বিমানের টিকিট ছিল বলে আমাদের আগে বাসে তুলে দেওয়া হল। দেখলাম আবার ঝমঝম করে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। সারা রাত বাসে ছিলাম। সকালে বেঙ্গালুরু পৌঁছোই। সেটা ৩ ডিসেম্বর, বৃহস্পতিবার। কিন্তু, কলকাতায় যাওয়া একটি উড়ানে একটি টিকিটও নেই। রাতে বেঙ্গালুরু থেকে পরের দিন শুক্রবার কলকাতা ফিরেছি।
তবে সরাসরি নয়। বেঙ্গালুরু থেকে প্রথমে উড়ে গিয়েছি দিল্লি। সেখান থেকে কলকাতায়। ইন্ডিগোর বিমানে। তবে, এর জন্য কোনও টাকা নেয়নি বিমানসংস্থা।