গ্রামবাসীদের উদ্যোগেই প্রাণ পেল কুট্টেমপেরোর নদী।
ক্লাস সিক্সের ভূগোলের পাঠ্য বই। ভারতের ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য বলতে প্রথমেই উঠে আসত একটা বিশেষণ। লেখা থাকত, ‘ভারত একটি নদীমাতৃক দেশ’। এককালে এ দেশে নদীই ছিল যোগাযোগের অন্যতম প্রধান মাধ্যম। নদী পথেই চলত ব্যবসা বাণিজ্য।
কিন্তু জনসংখ্যার বাড়বাড়ন্তে, অবৈজ্ঞানিক বসতি স্থাপনে, মানুষের লাগামছাড়া লোভে, কলকারখানা আর নাগরিক জীবনের আবর্জনার ভিড়ে নদীমাতৃক সেই দেশের মানচিত্র থেকেই মুখ লুকালো বেশির ভাগ নীল রঙা আঁকাবাঁকা রেখাগুলো। নদীর অভাবে নষ্ট হয়েছে পরিবেশের স্বাভাবিক ভারসাম্য, পানীয় জলের হাহাকার তীব্র হয়েছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। তবু আজও খবরের কাগজের পাতা ভরে বালি মাফিয়াদের দৌরাত্ম্য আর প্রোমোটারদের দাদাদিরিতে পুকুর বোজানোর মতো একাধিক খবরে। বিকল্প পথটাও যে আছে, তা যেন এক প্রকার ভুলেই গিয়েছিলেন মানুষ। প্রশাসনের দিকে আঙুল না তুলে, একে অপরকে দোষারোপ না করে, কাজটা করে দেখানোর দরকারটা ছিল। সেটাই করে দেখালেন কেরলের ৭০০ গ্রামবাসী। মাত্র ৭০ দিনের চেষ্টা। এই ক’দিনেই ফের নিজের খাতে ফিরল কুট্টেমপেরোর নদী।
কুট্টেমপেরোর-এর বুকে দাপিয়ে স্নান দামাল ছেলেদের
কেরলের আলাপুজা জেলার বুদ্ধানুর গ্রাম। সেই গ্রামেরই এক কালের লাইফ লাইন কুট্টেমপেরোর। পদ্মা আর আচানকোভিল নদীর সঙ্গে যুক্ত ছিল এই নদী। এক সময় ১২ কিলোমিটার লম্বা ও ১০০ মিটার চওড়া ছিল কুট্টেমপেরোর। গ্রামবাসীদের চাষবাস থেকে পানীয় জল, সবটারই যোগান দিত বুদ্ধানুরের ‘মা’। পরিবহণের জন্যও ব্যবহৃত হত এই নদী। কিন্তু একটা সময়ের পর থেকে অতিরিক্ত দূষণ আর পলিতেই মজতে শুরু করে কুট্টেমপেরোর। আগাছা জমতে থাকে। নৌকা চলাচল করাও প্রায় বন্ধ হয়ে যায়।
আরও পড়ুন: ফর্সা ত্বকে আকৃষ্ট সমাজকে সপাটে চড় কষালো এই তিন সুন্দরীর ছবি
নদীকে বাঁচাতে বদ্ধপরিকর ছিলেন গ্রামবাসীরা। বুদ্ধানুর গ্রাম পঞ্চায়েতের উদ্যোগে, মহাত্মা গাঁধী ন্যাশনাল রুরাল এমপ্লয়মেন্ট গ্যারান্টি অ্যাক্ট স্কিমের অধীনে শুরু হয় সাফাই অভিযান। পঞ্চায়েতের সভাপতি বিশ্বম্ভর পানিকের জানালেন, গ্রামের ১৪টি ওয়ার্ডের মোট ৭০০জন মিলে এই কর্মসূচিতে হাত লাগিয়েছিলেন। তাতে মহিলা-পুরুষ সকলেই ছিলেন। প্রায় ৭০ দিন সময় লেগেছিল পুরো কাজটা সম্পন্ন করতে। অবশেষে এ বছরেরই মার্চের শেষ দিকে নিজের পুরনো চেহারা ফিরে পায় এই নদী। টলটলে জলে নিজেকে ভরে এখন দিব্যি ‘স্বাস্থ্যবতী’ কুট্টেমপেরোর।
পঞ্চায়েতের হেড ক্লার্ক রেশমি প্রিয়া জানান, প্রথমে প্লাস্টিকের আবর্জনা সরিয়ে নদীর উপরিভাগ পরিষ্কার করা হয়েছিল। এরপর জলের নীচের আগাছা সাফাই শুরু হয়। এরও নীচে ছিল পুরু পলির স্তর। পলি স্তরও পরিষ্কার করেন গ্রামবাসীরা। তবে কাজটা যে মোটেও সহজ ছিল না তা স্বীকার করে নেন রেশমী।
‘‘সাফাই কাজ শুরুর এক মাস পর ফল পাওয়া যায় হাতে নাতে। যখন প্রথম নদীতে আবার নৌকা চলা শুরু হল, সে দিন আমরা আনন্দ চেপে রাখতে পারিনি। মনে হচ্ছিল, সবার স্বপ্ন একই দিনে সফল হল’’— জানালেন রেশমী।
এক সময় গ্রামবাসীদের কাছে এই নদীই ছিল পানীয় জলের অন্যতম উত্স। এখন কুট্টেমপেরোর জল স্নান করা ও জামাকাপড় কাচার কাজে ব্যবহৃত হলেও খাওয়ার জন্য এখনও এর জল ব্যবহার করেন না গ্রামবাসীরা, এমনটাই জানালেন পঞ্চায়েত সভাপতি বিশ্বম্ভর। তবে বিশ্বম্ভরের আশা খুব শীঘ্রই আবার পানের উপযোগী হবে কুট্টেমপেরোর।
সম্মিলিত ইচ্ছা থাকলে যে কোনও কাজই কঠিন নয়, সেটাই ফের এক বার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল বুদ্ধানুর।