নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর গত ৯ মাসে একজন মাত্র মুখ্যমন্ত্রীই তাঁর সঙ্গে দেখা করেননি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এক বারই শুধু রাষ্ট্রপতি ভবনে মোদীর মুখোমুখি পড়ে গিয়েছিলেন তিনি। সেই সাক্ষাৎ শুরু ও শেষ হয়েছিল মোদীর ‘দিদি ক্যায়সে হো’-র উত্তরে তৃণমূল নেত্রীর আড়ষ্ট নমস্কারে।
অরবিন্দ কেজরীবাল কিন্তু মমতার পথে হাঁটছেন না। আজ সকালে দিল্লি বিধানসভা ভোটের ফল স্পষ্ট হয়ে যেতেই ভাবী মুখ্যমন্ত্রীকে ফোন করে অভিনন্দন জানান মোদী। ভোটের প্রচারের সময়ে কেজরীবালকে যিনি বলেছিলেন ‘নকশাল’, আজ সেই মোদীই তাঁকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, দিল্লির উন্নয়নে কেন্দ্র সব রকম সাহায্য করবে। চায়ের আমন্ত্রণও জানিয়েছেন। কেজরীবালও উত্তরে বলেছেন, দু’এক দিনের মধ্যেই তিনি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করবেন।
এই কেজরীবাল কি নতুন কেজরীবাল?
এর আগের বার মুখ্যমন্ত্রীর আসনে ৪৯ দিন ছিলেন। তার মধ্যেই কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে ধর্নায় বসেছিলেন। বিধানসভায় আটকে যাওয়া তাঁর জন লোকপাল বিলকে কেন্দ্র ‘অবৈধ’ আখ্যা দেওয়ায় সরকার ভেঙে দিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর গদি ছেড়েছিলেন। আজ সেই কেজরীবালই প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সৌজন্য-সাক্ষাৎ করে কেন্দ্রের সঙ্গে হাত মিলিয়ে চলার বার্তা দিচ্ছেন।
কেন এই পরিবর্তন?
রাজনীতিকরা মনে করছেন, ৭০টির মধ্যে ৬৭টি আসনে জিতে আসা আম আদমি পার্টিকে নিয়ে দিল্লিবাসীর এখন আকাশচুম্বী প্রত্যাশা। বিদ্যুতের বিল অর্ধেক করা, বিনামূল্যে জল, নতুন স্কুল, হাসপাতাল, ঘুষ-মুক্ত সরকারি পরিষেবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসে এখন কার্যত বাঘের পিঠে সওয়ার কেজরীবাল। বিজেপিকে কোণঠাসা করে দিয়ে ক্ষমতায় এলেও এই বিপুল প্রত্যাশা পূরণ করতে গেলে পদে পদে মোদী সরকারের সাহায্য দরকার হবে তাঁর। সেই সব প্রশাসনিক বাধ্যবাধকতার কথা ভেবেই মোদীর সঙ্গে দেখা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন কেজরীবাল। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহের সঙ্গেও দেখা করার সময় চেয়েছেন।
কী রকম এই বাধ্যবাধকতা?
নির্বাচিত সরকার থাকলেও রাজধানী হওয়ার সুবাদে দিল্লি অনেকাংশে কেন্দ্রের উপরে নির্ভরশীল। সাধারণ ভাবে যে সব ক্ষমতা রাজ্য সরকারের হাতে থাকে, দিল্লিতে তার অনেকটাই কেন্দ্রের হাতে। যেমন, পুলিশ। এ বারের ভোটে কেজরীবালের অন্যতম প্রতিশ্রুতি ছিল মহিলাদের নিরাপত্তা। কিন্তু দিল্লির পুলিশবাহিনী রাজ্যের অধীন নয়। তা রাজনাথ সিংহের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের অধীনে। আগের বার আপ সরকারের আইনমন্ত্রী সোমনাথ ভারতীর কথা মতো দিল্লি পুলিশ কাজ না করায় সংসদের সামনে ধর্নায় বসেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী কেজরীবাল। এ বারের ভোটের আগেও তিনি বলেছিলেন, পুলিশবাহিনীকে রাজ্যের আওতায় আনা ও দিল্লিকে পূর্ণ রাজ্যের তকমা দেওয়ার জন্য কেন্দ্রের কাছে দাবি জানাবেন তিনি।
কিন্তু সে ক্ষেত্রে পুলিশবাহিনী চালানোর জন্য বছরে ৫ হাজার কোটি টাকা কে জোগাবে, তা-ও বড় প্রশ্ন। দিল্লি সরকারের সর্বশেষ বাজেট ৪০ হাজার কোটি টাকাও পেরোয়নি। সব ভেবেচিন্তেই দ্বিতীয় ইনিংসে ধর্না-রাজনীতির চেয়ে আলোচনা ও সহযোগিতার রাস্তাকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন আপ নেতৃত্ব। দলীয় নেতা আশুতোষের বক্তব্য, “কেজরীবালের এই নতুন অবতার আগের থেকে অনেক পরিণত। আমরা কেন্দ্রের সঙ্গে উন্নয়নের বিষয়ে আলোচনা করব।”
এ ক্ষেত্রে মাথায় রাখতে হবে, নয়াদিল্লি পুর নিগম চালান কেন্দ্রীয় সরকারি আমলারা। বাকি দিল্লিতে আরও যে তিনটি পুরসভা রয়েছে, সেই তিনটিই এখন বিজেপির হাতে। ফলে শুধু কেন্দ্র নয়, এই পুরসভাগুলির সঙ্গেও তাঁদের আলোচনায় বসতে হবে বলে আপ নেতারা জানিয়েছেন। তা ছাড়া, দিল্লির জমির মালিক দিল্লি ডেভেলপমেন্ট অথরিটি। এটি কেন্দ্রীয় নগরোন্নয়ন মন্ত্রকের অধীনস্থ সংস্থা। দিল্লির একটা বড় অংশই কেন্দ্রীয় পূর্ত মন্ত্রকের আওতায়। এ দিকে বিদ্যুৎ বণ্টন বেসরকারি হাতে। দিল্লিবাসীকে বিনামূল্যে জল বা অর্ধেক দামে বিদ্যুৎ দেওয়ার জন্য ভর্তুকি দিতে গেলে কেন্দ্রের অর্থসাহায্যের উপরে নির্ভর করতে হবে কেজরীবালকে।
ভাবী মুখ্যমন্ত্রীর হাতে তা হলে থাকছে কী? জন লোকপাল নিয়ে আন্দোলন করেই মুখ্যমন্ত্রীর গদিতে আসার পথ তৈরি করেছিলেন কেজরীবাল। নির্বাচনী ইস্তাহারে তাঁরা মহল্লা সভার মাধ্যমে দিল্লি সরকার চালানোর জন্য স্বরাজ বিল পাশ করানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কিন্তু বাস্তব হল, কেন্দ্রের অনুমোদন ছাড়া কেজরীবাল সরকারের পক্ষে বিধানসভায় জন লোকপাল বা স্বরাজ বিল পেশ করা দূরে থাক, মন্ত্রিসভায় আলোচনা করাই সম্ভব নয়। আইন অনুযায়ী, আগে এই সব বিলের খসড়া উপরাজ্যপাল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকে পাঠাবেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক পাঠাবে রাষ্ট্রপতির কাছে। রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের পর সেই বিল ফের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক, উপরাজ্যপালের হাত ঘুরে মন্ত্রিসভায় আসবে।
কেন্দ্র যদি এই সব বিলে অনুমোদন না দেয়? এ প্রসঙ্গেও আপ নেতারা জানাচ্ছেন, প্রথমেই তাঁরা সংঘাতে যাওয়ার পক্ষপাতী নন। বরং তাঁদের প্রথম লক্ষ্য, কেন্দ্রের সঙ্গে হাত মিলিয়ে দিল্লিতে আরও উন্নয়নের চেষ্টা। গত বার সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল না। এ বার আম আদমির বিপুল ভোট মিলেছে। উন্নয়নের চেষ্টা করেও ইতিবাচক ফল না মিললে কেন্দ্রের ঘাড়ে দায় ঠেলে দেওয়ার রাস্তা তো খোলাই থাকছে।
শিল্পমহলের আস্থা অর্জনও কেজরীবালের কাছে বড় চ্যালেঞ্জ। শিল্পপতিদের একাংশের বিশ্লেষণ, কিছু ক্ষেত্রে তিনি বামপন্থীদের থেকেও বেশি কট্টরপন্থী। কেজরীবাল নিজে বানিয়া সম্প্রদায়ের মানুষ। এক দিকে তিনি ব্যবসায়ীদের স্বার্থের কথা ভেবে দিল্লিতে ইন্সপেক্টর-রাজ বন্ধ করার প্রতিশ্রুতি দেন। ভ্যাট-এর হার সবথেকে কম করার কথা বলেন। অন্য দিকে তিনি খুচরো ব্যবসায় বিদেশি লগ্নির বিরোধী। ঠিকা শ্রমিক তুলে দেওয়ার পক্ষপাতী। মুখ্যমন্ত্রিত্বের প্রথম ইনিংস থেকেই দেশের প্রথম সারির শিল্পপতিদের বিরুদ্ধে তিনি জেহাদ ঘোষণা করেছেন। দিল্লির বিদ্যুৎ বণ্টন বেসরকারি সংস্থার হাতে থাকলেও নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিতে তিনি বিদ্যুতের দাম অর্ধেক করে দেওয়ার কথা বলেছেন। বেসরকারি সংস্থার হিসেবনিকেশ পরীক্ষার হুমকিও দিয়েছেন। ফলে অনেকের মতে, শিল্পমহলের আস্থা অর্জনে এ বার হয়তো নিজের সঙ্গেও লড়তে হবে কেজরীবালকে।
প্রতিশ্রুতিগুলি কী কী?
দিল্লির নিজস্ব বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র, ৫০০ নতুন স্কুল, ২০টি কলেজ, সরকারি হাসপাতালে বেডের সংখ্যা চার গুণ করে দেওয়া, ৪ হাজার নতুন চিকিৎসক, ১৫ হাজার নতুন স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগ, দু’লক্ষ সরকারি শৌচাগার তৈরি, ইত্যাদি ইত্যাদি। সব কিছুই ‘ইউটোপিয়া’ হয়ে থেকে যাবে না তো? আপ-নেত্রী মীরা সান্যালের জবাব, “যথেষ্ট গবেষণা এবং দিল্লির মানুষের সঙ্গে কথা বলেই ইস্তাহার তৈরি হয়েছে। যে সব কাজ করা সম্ভব, তার প্রতিশ্রুতিই দিয়েছি আমরা।”
আপ নেতা আশুতোষের ব্যাখ্যা, “মোদী সরকার প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে পারেনি। তাই ৯ মাসের মধ্যেই দিল্লিতে বিজেপি মুখ থুবড়ে পড়েছে। এটা যেমন বিজেপির কাছে শিক্ষা, আমাদের কাছেও শিক্ষা।”
কেন্দ্রীয় মন্ত্রী রবিশঙ্কর প্রসাদের চ্যালেঞ্জ, “কেন্দ্র সাহায্য করবে। সংখ্যাগরিষ্ঠতাও রয়েছে। এ বার আপ প্রতিশ্রুতি পালন করে দেখাক।”