ফাইল চিত্র
অক্টোবরের শুরুতেই বাতাসে হিম সোনমার্গে। দূরে পাহাড়ের মাথায় জমে থাকা বরফ ভোরের সূর্যের আলোয় গলানো সোনার রং ধরেছে। সে দিকে তাকিয়ে সোনমার্গের বছর পঞ্চান্নের গুলাম রসুল বলে চলেন, ‘‘কোথায় আফগানিস্তান আর কোথায় কাশ্মীর। এত সোজা না কি!’’
আফগানিস্তানে তালিবানের ক্ষমতাদখল বাড়িয়ে দিয়েছে জঙ্গি তৎপরতা। কাশ্মীরের তরুণদের একাংশও ‘উৎসাহিত’। তালিব জঙ্গিদের আফগানিস্তান দখলের ভিডিয়ো, মার্কিন সেনাদের পশ্চাদপসারণ— এমন সব ভিডিয়ো মোবাইল থেকে মোবাইলে শেয়ার হয়ে চলেছে অনবরত। অনেকেই ভাবছেন, পাকিস্তানের মদতে নিয়ন্ত্রণরেখা পেরিয়ে তালিব যোদ্ধারা ঢুকে আজাদ করবে কাশ্মীরকে। পোড়খাওয়া হোটেল মালিকের বিশ্লেষণ, তরুণদের একটা অংশ এ সব নিয়ে খুবই উৎসাহী। তাঁরা ভাবছে হয়তো এ ভাবে কাশ্মীর সমস্যার সমাধান সম্ভব। কিন্তু উপত্যকায় যত এ সব বাড়বে, কড়াকড়ি বাড়বে সেনার। রসুলের কথায়, ‘‘আমি চাইব, কাশ্মীর নিয়ে ভারত-পাকিস্তানের এই লড়াই বন্ধ হোক। যাতে জাঁতাকলে এই নিত্য দিনের পিষে যাওয়া থেকে মুক্তি পায় কাশ্মীরের মানুষ।’’
কিন্তু তালিবান জঙ্গিরা কি পাক অধিকৃত কাশ্মীর পেরিয়ে এসে সন্ত্রাস চালাতে পারে? স্থানীয় যুবকদের নতুন করে অস্ত্র হাতে তুলে নেওয়ার সম্ভাবনা কতটা? জম্মু-কাশ্মীরের স্পেশাল অপারেশন গ্রুপের পুলিশ সুপার তারিক বাটের সঙ্গে আলাপ বালতালে, জোজিলা সুড়ঙ্গমুখের সামনে। তাঁর কথায়, ‘‘অক্টোবর থেকেই পাহাড়ে বরফ পড়া শুরু হয়ে যায়। ১৫ অক্টোবরের পর থেকে সেই বরফ ডিঙিয়ে ঢোকার খুব একটা চেষ্টা করে না জঙ্গিরা। তাই এ বছর নতুন করে অনুপ্রবেশের সম্ভাবনা খুবই কম। গরমে বরফ গললে অনুপ্রবেশ বাড়বে। আপাতত প্রায় ছয় মাসের জন্য তালিবান কেন, প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে কেউই অনুপ্রবেশের চেষ্টা করবে না।’’
১৬টি পুলিশ পদক বিজেতা তারিক আত্মবিশ্বাসী, তালিব জঙ্গিরা আফগানিস্তানে ক্ষমতা দখল করলেও, ভারতের মাটিতে তাদের দাঁত ফোটানো কঠিন। কেন? তাঁর ব্যাখ্যা, আফগানিস্তানে তালিব জঙ্গিদের অর্থ, অস্ত্র-গোলাবারুদ, লোকবল জোগানোর পিছনে সুগঠিত নেটওয়ার্ক ছিল, যা দীর্ঘ সময় ধরে গড়ে উঠেছে। সে দেশে তালিব জঙ্গিরা যে অবাধ গতিবিধির সুযোগ পেয়েছে, তা এ দেশে পাওয়া সম্ভব নয়। কারণ, তালিবদের ভারতে আসতে গেলে সীমান্ত পেরিয়ে অনুপ্রবেশ করতে হবে। তাঁর কথায়, ‘‘নব্বইয়ের দশকে সীমান্তে যথেষ্ট নজরদারির অভাবে জঙ্গিরা দলে দলে ঢুকেছিল। এখন তা করতে গেলে চার-ছয় জনের ছোট দলেই ঢুকতে হবে। আর অনুপ্রবেশকারীরা হয় সীমান্তে গুলি খাবে বা উপত্যকায় পৌঁছলে আমাদের হাতে মারা যাবে। হাম ঠোক দেঙ্গে। ছোড়েঙ্গে নেহি।’’
উপত্যকার যুব সমাজের তালিবানি আর্দশে প্রভাবিত হওয়ার সম্ভাবনা কতটা? ওই অফিসারের দাবি, কাশ্মীরে যে মতবাদই ছড়িয়ে পড়ে, তার পিছনে হাত থাকে পাকিস্তানের। ২০১৫-১৭ সালে সন্ত্রাসের ঘটনায় ইন্ধন দিতে আইএসের ভাবাদর্শ প্রচার হয়েছিল উপত্যকায়। কিছু যুবক তাতে প্রভাবিত হন। কিছু দিন কাশ্মীরে আইএসের ফ্ল্যাগ, লিফলেট প্রচার সবই হয়। কিন্তু এখন কাশ্মীরে আইএসের ন্যূনতম প্রভাব নেই বলে তাঁর দাবি। এ বারও তালিবানকে কিছু উপত্যকাবাসী পরিত্রাতা হিসাবে মনে করছেন ঠিকই, কিন্তু তাঁদের কট্টর চেহারা সামনে আসতেই উৎসাহ কমছে। নিজের ১৪ বছরের কর্মজীবনে প্রায় একশোর কাছাকাছি জঙ্গি দমন অভিযানে অংশ নেওয়া ওই পুলিশ অফিসারের কথায়, ‘‘কাশ্মীরের জনতা শান্তিপ্রিয়। তাঁদের জিনে সন্ত্রাস নেই। বরং এখানকার মানুষ অনেক বেশি উদার।’’
শ্রীনগরের চিত্র সাংবাদিক তৌসিফ জামালের মতেও, তালিবান প্রশ্নে সাময়িক উন্মাদনা, আবেগ কাজ করেছিল উপত্যকায়। এত দিনের ঘাত-প্রতিঘাতে তিতিবিরক্ত অনেকেই ভেবেছেন, তালিবান এসে সমস্যার সমাধান করে দেবে। কিন্তু তালিব জঙ্গিদের কট্টর চেহারা যত সামনে এসেছে, তত উপত্যকাবাসী মুখ ফেরাতে শুরু করেছেন। হোটেল মালিক গুলাম রসুলের কথায়, ‘‘আম কাশ্মীরি সমানাধিকারের পক্ষে। উপত্যকায় আর্থিক উন্নয়ন হোক, লোকে চাকরি পাক, পর্যটন ব্যবসার উন্নতি হোক, এটাই চাইব।’’
সোনমার্গের বিভিন্ন এলাকা পর্যটকদের ঘোড়ায় চড়িয়ে ঘুরিয়ে দেখান স্থানীয় বাসিন্দা রামিজ। বছরের ছয় মাস রোজগার। অক্টোবরে বরফ পড়া শুরু হতেই হাত খালি রামিজদের। তবু বছর বাইশের রামিজ বাবার পেশাতেই হাত লাগিয়েছেন। আফগানিস্তান তালিবান জঙ্গিদের ক্ষমতায় আসার কথা বিলক্ষণ জানলেও, তাঁর মতে, ‘‘ও সব ঝামেলা যত দূরে থাকে, ততই মঙ্গল। আমরা তালিবান নয়, পর্যটক চাই। যাতে গোটা বছর পেট চলে যায়।’’ তবে রামিজের স্বীকারোক্তি, কমবয়সিদের একাংশ তালিবরা ক্ষমতায় আসায় উৎফুল্ল। কিন্তু তাতে সমস্যার কোনও সুরাহা হবে না বলেই তাঁর মত। তরুণের কথায়, ‘‘তালিবানের দাপট বাড়লে কাশ্মীরে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে। পর্যটক আসা বন্ধ হয়ে যাবে। বাড়বে সেনা কড়াকড়ি। এক পক্ষের হাতে পাথর উঠলে, অন্য পক্ষ নেবে ছররা বন্দুক। আবার কার্ফু হবে। আমরা পেট চালাতে চাই। পর্যটক চাই।’’
(চলবে)