ফাইল চিত্র।
‘‘ছেলের জন্য যখন দেড়শো টাকা কেজি দরে আপেল কিনে নিয়ে আসি, তখন গল্প শোনাই, আমাদের আপেলের বাগান ছিল। বাড়ির গাছে আখরোট হত। ছেলে যখন অবাক হয়ে শোনে, আমারই চোখ জলে ভিজে যায়।’’
ছোট্ট ছেলের হাত ধরে আজ বিকেলে যন্তর মন্তরে এসেছিলেন আশু ত্রিসল। সপ্তাহের কাজের দিনে পরা হয় না বলে এ দিন লম্বা হাতের কাশ্মীরি ফিরন গায়ে চাপিয়েছিলেন। পুলওয়ামায় তিন দশক আগে ছেড়ে আসা বাড়ির গল্প শোনাচ্ছিলেন।
৩০ বছর আগে এই দিনেই কাশ্মীর উপত্যকা থেকে কাশ্মীরি পণ্ডিতদের ঘর ছাড়া শুরু হয়েছিল। আজ সেই দিনেই কাশ্মীরে ফেরার দাবিতে বিক্ষোভ দেখালেন পণ্ডিতেরা। দিল্লির যন্তর মন্তরের পাশাপাশি জম্মুতে উপরাজ্যপাল জি সি মুর্মুর বাসভবনের সামনেও বিক্ষোভ দেখান তাঁরা। উপরাজ্যপালের হাতে স্মারকলিপিও তুলে দেন।
জম্মু-কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা লোপের পর থেকেই পণ্ডিতদের উপত্যকায় ফেরানোর প্রশ্নে ফের রাজনীতি শুরু হয়েছে। কাশ্মীরি পণ্ডিতদের মধ্যেও আশার আলো জেগেছে। তিন দশক আগের সেই ঘরছাড়ার প্রতিবাদে যন্তর মন্তরে তাই কয়েকশো কাশ্মীরি পণ্ডিত জড়ো হয়েছিলেন। মাথায় ‘হলোকস্ট ডে’ লেখা কালো ফেট্টি বাঁধা ছিল। ‘হম ওয়াপস আয়েঙ্গে’ থেকে ‘হম আ রাহে হ্যায়’ ধ্বনি উঠেছে। কিন্তু সেইসঙ্গে প্রশ্নও জেগেছে।
পিডিপি-বিজেপি জোট বাঁধার পরে মেহবুবা মুফতির আমলে কাশ্মীর উপত্যকায় কাশ্মীরি পণ্ডিতদের জন্য বেশ কিছু শিবির তৈরি হয়েছিল। চার দিক উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। পাঁচিলের উপরে কাঁটাতার। শিবিরের ভিতরে একতলা বাড়ি। তৈরি হয়েছিল পুনর্বাসন প্যাকেজ। পণ্ডিতদের ফিরিয়ে নিয়ে এসে এ ভাবে শিবির-বন্দি করে আলাদা রাখা নিয়ে কাশ্মীরি মুসলিমদের মধ্যেও ক্ষোভ তৈরি হয়েছে।
ফিরে গিয়ে কি শিবিরে থাকতে চান? আশু ত্রিসলের জবাব, ‘‘একেবারেই না। আমরা কি ভিন্ রাজ্যের শ্রমিক? নিরাপত্তার জন্য শিবির তৈরির কথা বলা হয়েছে। কিন্তু ওখানে তো সন্ত্রাসবাদী হামলা করা আরও সহজ। কাশ্মীরি পণ্ডিতদের নিশানা করার জন্য খোঁজাখুঁজি করারও দরকার নেই।’’ ওই শিবিরগুলিতে এখন সরকারি পদে নিযুক্ত পণ্ডিতেরাই থাকেন। কাশ্মীর উপত্যকার অধিকাংশ জায়গাতেই কাশ্মীরি পণ্ডিতদের ফেলে আসা বাড়ি-জমি যেমন ছিল, তেমনই রয়েছে। সময়ের সঙ্গে বাড়ি ভেঙে পড়েছে। কিন্তু কেউ তা জবরদখল করেনি। আশু বলেন, ‘‘আমরা তো পুরনো ভিটেমাটিতেই ফিরতে চাই। কিন্তু তার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ চাই।’’
বিচ্ছিন্নতাবাদী ও জঙ্গিদের উপদ্রবে কাশ্মীরি পণ্ডিতদের উপত্যকা ছাড়ার প্রেক্ষিতে তৈরি হওয়া একটি ছবির সংলাপকে উদ্ধৃত করে ‘হাম ওয়াপস আয়েঙ্গে’ হ্যাশট্যাগে টুইটারে প্রচার চলছে বেশ কিছু দিন ধরেই। সরব হয়েছেন মার্কিন কংগ্রেসে কাশ্মীরি পণ্ডিত তথা ভারতের পক্ষে সওয়াল করা কলমলেখক সুনন্দা বশিষ্ঠ, লেখক রাহুল পণ্ডিতা-সহ বিশিষ্ট কাশ্মীরি পণ্ডিতেরা।
কেন্দ্রীয় সরকার বলছে, বিশেষ মর্যাদা লোপের পরে কাশ্মীরি পণ্ডিতদের ফেরানো হবে। আজ জম্মুতে গিয়ে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অনুরাগ সিংহ ঠাকুর যুক্তি দিয়েছেন, ‘‘কাশ্মীরি পণ্ডিতদের কাশ্মীরে ফিরে যাওয়ার ও অধিকার ফিরে পাওয়ার সঠিক সময় এসে গিয়েছে।’’ কিন্তু আশুর যুক্তি, ‘‘ফিরে গেলেই তো হল না। রোজগার, নিরাপত্তা, শিক্ষা, সব কিছুরই ব্যবস্থা করতে হবে। পর্যটক হিসেবে তো যাতায়াত করিই।’’ ‘রুটস ইন কাশ্মীর’-এর আহ্বায়ক অনুপ ভাট বলেন, ‘‘আমাদের সংস্কৃতি আস্তে আস্তে ম্লান হয়ে যাচ্ছে। অস্তিত্ব সঙ্কটের মুখে।’’