বাড়িতে বিজয়েন্দ্র। নিজস্ব চিত্র
সম্ভবত লক্ষ্য ছিল মুখ্যমন্ত্রীর কুর্সি। তাই ‘জায়ান্ট কিলার’ হিসেবে বরুণা বিধানসভা কেন্দ্র থেকে লড়তে চেয়েছিলেন চার-চার বারের মুখ্যমন্ত্রী ইয়েদুরাপ্পার ছোট ছেলে বিজয়েন্দ্র। কৌশল ছিল, কংগ্রেসের ‘হেভিওয়েট’ নেতা তথা প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী সিদ্দারামাইয়াকে হারিয়ে মুখ্যমন্ত্রিত্বের দাবি পেশ।কিন্তু সেই পরিকল্পনায় জল ঢেলে দেন খোদ বিজেপি শীর্ষ নেতৃত্ব। ছেলে মুখ্যমন্ত্রী হলে, ফের কর্নাটকে ইয়েদুরাপ্পা-রাজ শুরু হওয়ার আশঙ্কায় বরুণা কেন্দ্রে বিজয়েন্দ্রের লড়ার প্রস্তাব গোড়াতেই বাতিল করে দেয় দল। উল্টে, লক্ষ্মণের গণ্ডি কেটে ‘পৈতৃক’ বিধানসভা আসন শিকারিপুরেই ‘আটকে দেওয়া হয়’ ইয়েদুরাপ্পা-পুত্রকে।
অথচ সিদ্দারামাইয়াকে হারাতে পারলে, মুখ্যমন্ত্রিত্বের দাবি পোক্ত হবে বলে ছক কষেই বছর খানেক আগে থেকে বরুণায় সক্রিয় হয়ে উঠেছিলেন বিজয়েন্দ্র। স্থানীয় লিঙ্গায়েত সমাজের ভোট নিজের দিকে টানার হিসাব কষে জনভিত্তি গড়ার কাজ শুরু করে দেন। অন্য দিকে ইয়েদুরাপ্পার কৌশল ছিল, ছেলে বরুণা থেকে জিতলে এবং মুখ্যমন্ত্রী হলে, কর্নাটকের রাজনীতি নতুন করে ছেলের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা। বিজেপির অন্দরের খবর, সেই সম্ভাবনা অঙ্কুরে বিনাশ করতে, বিশেষত কর্নাটকি রাজনীতিতে ইয়েদুরাপ্পার প্রভাব সীমিত রাখতে বিজয়েন্দ্রকে শিকারিপুর থেকে লড়ার প্রস্তাব দেয় দল। বিজয়েন্দ্র-ঘনিষ্ঠ স্থানীয় বিজেপি কর্মী ভেঙ্কটেশের বক্তব্য, ‘‘দল থেকে বলে দেওয়া হয়, লড়তে হলে শিকারিপুর। না হলে অন্য কোথাও নয়।’’
শিমোগা থেকে মেরেকেটে পঞ্চাশ মিনিটের রাস্তা। পাহাড়-জঙ্গল দু’ভাগ করে মসৃণ পিচ ঢালা রাস্তা চলে গিয়েছে। চাষের খেত সরে গিয়ে রাস্তার দু’ধারে বহুতলের সারি শুরু হতেই চালক জানালেন, পৌঁছে গিয়েছি শিকারিপুর। ভোজবাজির মতো পাল্টে গেলে দু’ধারের দৃশ্যপট। এতক্ষণ যেখানে রাস্তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চাষের খেত, শালের জঙ্গল দৌড়চ্ছিল, এখন সেখানে সার দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে একের পর এক বহুতল। ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, আইটিআই, উচ্চ বিদ্যালয়। ঝকঝকে রাস্তাঘাট, আধুনিক মানের হাসপাতাল, মাল্টিপ্লেক্স, বাস স্ট্যান্ড সবই রয়েছে ছোট্ট এই জনপদে।
সকাল আটটায় যখন বিজয়েন্দ্রের বাড়ির সামনে পৌঁছলাম, তখন গোটা এলাকা গমগম করছে কর্মী-সমর্থকদের ভিড়ে। সকাল সকাল স্নান সেরে বাড়ি-বাড়ি প্রচারের জন্য প্রস্তুত ইয়েদুরাপ্পা-পুত্র। বড় ভাই রাঘবেন্দ্র সাংসদ। মাঝে দু’বোন। বিবাহিত দুই বোনও সকাল-সকাল চলে এসেছেন ছোট ভাই বিজয়েন্দ্রের প্রচারসঙ্গী হতে।
প্রার্থী হিসেবে বেশ প্রত্যয়ী বিজয়েন্দ্র। বললেন, ‘‘জেতা নিয়ে কোনও চাপ নেই। বাবা ইয়েদুরাপ্পার জুতোয় পা গলাতে চলেছি, এটাই সবচেয়ে বড় চাপ। তবে মানুষের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারব বলেই বিশ্বাস করি।’’ মেনে নিলেন, বরুণায় লড়ার জন্য সেখানে ‘হোমওয়ার্ক’ করা শুরু করে দিয়েছিলেন। কিন্তু সেই ইচ্ছাপূরণ হয়নি। তাঁর কথায়, ‘‘দলের ইচ্ছাই শেষ কথা। তা ছাড়া, শিকারিপুরের মানুষের কাছে আমাদের পরিবারের দায়বদ্ধতা রয়েছে। তাই সবদিক বিচার করে এখান থেকেই লড়ার সিদ্ধান্ত।’’
পাঁচ মিনিটের সাক্ষাৎকার শেষ হল কুড়ি মিনিটে। তার পরে প্রাতঃরাশ করে যেতে বলেই কর্মীদের ভিড়ে মিশে গেলেন বিজয়েন্দ্র। বাড়ির উল্টো দিকেই পেল্লায় দলীয় দফতর। দু’ধারে পাতা টেবিলে ভোটার তালিকা নিয়ে শেষ মুহূর্তের হিসাব সারছিলেন কর্মীরা। লম্বা ঘরের শেষ মাথায় ক্যান্টিন। দলীয় কাজের জন্য দূরদূরান্ত থেকে যাঁরা আসছেন, তাঁরা সবাই আগে উপমা আর কফি খেয়ে চাঙ্গা হয়ে নিচ্ছেন।
এখানেই আলাপ হল উমেশ ভট্টের সঙ্গে। চাকরি সূত্রে দীর্ঘদিন উত্তরপ্রদেশে থেকেছেন এই অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মী। ইয়েদুরাপ্পার কট্টর সমর্থক উমেশের কথায়, ‘‘উত্তরপ্রদেশে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে মুলায়ম যে ভাবে নিজের পৈতৃক গ্রাম সাইফাই-কে আধুনিক শহরে পরিণত করেছেন, শিকারিপুরের ভোল বদলের পিছনে তেমনই ইয়েদুরাপ্পা। ফলে তাঁর ছেলে এখানে যে জিতবে, সেটাই তো স্বাভাবিক।’’ তা ছাড়া, ইয়েদুরাপ্পার পক্ষে লিঙ্গায়েত সমাজের ভোট রয়েছে গোটা এলাকায়। অন্য দিকে, গোটা উপকূলবর্তী কর্নাটক জুড়ে যেখানে মুসলিম সমাজ বিজেপিকে হারাতে মরিয়া, সেখানে শিকারিপুরের মুসলিমদের এক বড় রয়েছেন বিজেপি প্রার্থীর পাশে!
এর কারণটা অবশ্য বিজয়েন্দ্রই খোলসা করলেন। তাঁর দাবি, ‘‘বাবা সব সময়েই সকলকে নিয়ে চলায় বিশ্বাসী ছিলেন। আমিও সেই রাস্তায় চলায় বিশ্বাসী।’’
চায়ের দোকানে আলাপ হুচারায়াপ্পার সঙ্গে। ইয়েদুরাপ্পার সঙ্গে লতায়-পাতায় সম্পর্ক। তাঁর দাবি, ‘‘শিকারিপুরের বড় অংশের সঙ্গে ইয়েদুরাপ্পার রক্তের সম্পর্ক রয়েছে। সব মিলিয়ে যা চিত্র, তাতে শিকারিপুরে জেতার প্রশ্নে বিজয়েন্দ্রের অন্তত কোনও সমস্যা নেই।’’
কিন্তু সমস্যা অন্য জায়গায়। লিঙ্গায়েত সমাজ বরাবরই বিজেপির শক্ত আর নিশ্চিত ভোটব্যাঙ্ক। কিন্তু যে ভাবে এই সমাজের সবচেয়ে বড় নেতা ইয়েদুরাপ্পাকে এ যাত্রায় বিজেপি গুরুত্বহীন করার কৌশল নিয়ে চলছে, তা নাকি আদৌও ভাল ভাবে নেননি লিঙ্গায়েতরা। রাজ্য রাজনীতিতে ইয়েদুরাপ্পাকে বিশেষ গুরুত্ব না দেওয়া, শুধু লিঙ্গায়েত-প্রধান এলাকায় প্রচারে আটকে রাখা, লিঙ্গায়েত নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ দিতে পারে এমন ভোক্কালিগা নেতাদের প্রচারের আলোয় তুলে আনা— এ ধরনের নানা ঘটনা পরম্পরায় রাজ্যের সব থেকে বড় মাপের লিঙ্গায়েত নেতার সঙ্গে বিমাতৃসুলভ আচরণের গন্ধ পেয়ে বেজায় ক্ষুব্ধ লিঙ্গায়েত সমাজের বড় অংশ।