ফাইল চিত্র।
২০২০ সালের ৫ জানুয়ারি। কনকনে শীতের মাঝরাতেও সে দিন উত্তপ্ত জেএনইউ ক্যাম্পাস। পুলিশ আর আধাসেনায় ছয়লাপ। তার কয়েক ঘণ্টা আগে কাপড়ে মুখ ঢেকে বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে চড়াও হয়ে তাণ্ডব চালিয়ে গিয়েছে এক দল দুষ্কৃতী। একাধিক হস্টেল তছনছ। বহু পড়ুয়া রক্তাক্ত। এমনকি লাঠি পড়েছে অধ্যাপিকার মাথায়। সারা দেশে সাড়া ফেলে দেওয়া এমন ঘটনার পরে বছর গড়িয়ে যাওয়া সত্ত্বেও তদন্ত এগোতে পারল না দিল্লি পুলিশ! গ্রেফতার করা যায়নি এক জনকেও। ক্ষুব্ধ ছাত্র-ছাত্রীদের অনেকের অভিযোগ, সঙ্ঘের ছাত্র সংগঠন এবিভিপি ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার কারণেই কোভিড আর লকডাউনের সুযোগে তদন্তকে ঠান্ডা ঘরে পাঠিয়েছে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের ‘কথা মানা’ দিল্লি পুলিশ।
মাথায় রডের আঘাতে সে দিন রক্তাক্ত হয়েছিলেন জেএনইউয়ের ছাত্র সংসদ জেএনইউএসইউয়ের প্রেসিডেন্ট ঐশী ঘোষ। মঙ্গলবার তাঁর ক্ষোভ, ‘‘বছর পেরিয়েও অধরা রয়ে গেল ন্যায় বিচার।’’ গোড়া থেকেই তাঁদের দাবি, বামপন্থী ছাত্র আন্দোলনের ঘাঁটি বলে পরিচিত এই কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ওই হামলা ছিল সুপরিকল্পিত। তাতে মদত ছিল খোদ জেএনইউ প্রশাসনের। আর এবিভিপি এতে জড়িত বলেই হাতে রড, লাঠি, হকি স্টিক নিয়ে হস্টেলে হানা দেওয়া দুষ্কৃতীদের ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়ার পরেও এক বছরে এক জনকেও গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। উল্টে এই ঘটনায় এফআইআর দায়ের হওয়ার পরে অভিযুক্তদের যে তালিকা তারা সামনে এনেছিল, তাতে পাল্লা ভারী সে দিন ‘আক্রান্ত’ পড়ুয়াদের নামেরই।
ছাত্র সংগঠন এআইএসএ-র প্রেসিডেন্ট এন সাই বালাজির বক্তব্য, কারা ওই দিন সন্ধ্যার মুখে সশস্ত্র হামলা চালিয়েছিল, চড়াও হয়েছিল বিভিন্ন হস্টেলে, তা কারও অজানা নয়। কিন্তু এক বছর পেরিয়েও তদন্ত সেই বিশ বাঁও জলে।
অভিযোগ, প্রথম দিকে এ নিয়ে যেটুকু নাড়াচাড়া হয়েছিল, তাতে চেষ্টা হয়েছিল উল্টে বামপন্থী ছাত্র সংগঠনগুলির উপরে দোষ চাপানোর। যেমন, প্রথমে সাংবাদিক সম্মেলনে এবিভিপি-র নাম পর্যন্ত উচ্চারণ করেনি পুলিশ। বরং জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডেকে পাঠানো হয়েছিল ঐশী-সহ বিভিন্ন বামপন্থী ইউনিয়নের সদস্যদের। অথচ হস্টেল করিডরে হাতে লাঠি আর মুখে কাপড় বাঁধা যে কোমল শর্মার ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় ছয়লাপ হয়েছিল, বেশ কয়েক মাস নাকি তাঁর খোঁজই পায়নি পুলিশ! পরে নিজেকে নির্দোষ বলে দাবি করেছেন তিনি। তদন্ত ঠিক পথে না-এগোনো নিয়ে শুরু থেকেই ক্ষোভ ছিল। পরে করোনার কামড় এবং সেই সূত্রে লকডাউনের সুবাদে তাকে ঠান্ডা ঘরে পাঠাতে সুবিধা হয়েছে দিল্লি পুলিশের।
জেএনইউয়ের এবিভিপি নেতা সুজিত শর্মার অভিযোগ, গত বছরের ৫ জানুয়ারি ওই ঘটনার আগে দুপুরে হস্টেলে লাঠিসোটা হাতে চড়াও হয়েছিলেন বামপন্থী ইউনিয়নের অনেকে। ছিলেন ঐশীও। মারধরের জন্য এবিভিপি সদস্যদের খোঁজ করছিলেন তাঁরা। তার বিচার কই? এসএফআই, এআইএসএ-র মতো বামপন্থী ইউনিয়নগুলির বক্তব্য, তদন্তের ফল সামনে এলেই তো দোষী খুঁজে পাওয়া যেত। তাহলে তাতে পুলিশের গড়িমসি কেন?
এক বছর আগের ওই ঘটনাবহুল বিকেল ও সন্ধ্যায় আতঙ্কে কাঁটা হয়ে থাকতে হয়েছিল পড়ুয়াদের। হস্টেলে ব্যাপক ভাঙচুর। রাস্তা-ঘাটে মারধর। অভিযোগ, বেছে বেছে নিশানা করা হয়েছিল সংখ্যালঘু ও কাশ্মীরী পড়ুয়াদের। আক্রমণ থেকে বাদ যাননি দৃষ্টিহীন ছাত্রও। তার পরে প্রায় এক মাস এই ঘটনাকে ঘিরে সরগরম ছিল দেশ। আক্রান্ত পড়ুয়াদের পাশে দাঁড়াতে বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছিলেন বহু নামী জন। হঠাৎ উপস্থিত হয়েছিলেন অভিনেত্রী দীপিকা পাড়ুকোনও।
এর পরে এক বছরে যমুনায় বহু জল বয়ে গিয়েছে। করোনা আর লকডাউনে অচল হয়েছে দেশ। রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করা কঠিন হয়েছে পড়ুয়াদের পক্ষে। যে জেএনইউকে বিজেপির অনেকে ‘দেশদ্রোহীদের আখড়া’ বলে দেগে দিতেন, তার ক্যাম্পাসেই স্বামী বিবেকানন্দের মূর্তি উন্মোচন করেছেন খোদ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। প্রশংসায় ভরিয়ে দিয়েছেন এই বিশ্ববিদ্যালয়কে।
কিন্তু এত কিছুর পরেও বসন্তকুঞ্জ থানায় দায়ের হওয়া এফআইআরের হিল্লে আর হয়নি। কেউ গ্রেফতার হননি। তদন্তের গতি কমতে কমতে নেমে এসেছে প্রায় শূন্যে। এমনকি মাঝেমধ্যেই প্রশ্ন উঠেছে তাতে পুলিশের ভূমিকার নিরপেক্ষতা নিয়ে।
এক সময় তদন্তে গতি আনতে বিশেষ তদন্তকারী দল গঠিত হয়েছে। তারা জিজ্ঞাসাবাদ করেছে বেশ কয়েক জনকে। কিন্তু রিপোর্ট অপ্রকাশিত!
বছর পেরিয়েও জেএনইউ-কাণ্ডের রহস্য উন্মোচন তাই সেই তিমিরে।