সাংবাদিক বৈঠকে জেএনইউ হামলায় সন্দেহভাজনদের ছবি প্রকাশ করছেন অপরাধদমন শাখার ডিসিপি জয় তিরকে (বাঁ দিকে)। ছবি: পিটিআই।
পাঁচ দিন কেটে গেলেও জেএনইউ-তাণ্ডবে অভিযোগের আঙুল ওঠা এক জনকেও গ্রেফতার বা আটক করেনি দিল্লি পুলিশ। উল্টে বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে তার আগে হওয়া একটি গন্ডগোলে যুক্ত থাকার অভিযোগে জেএনইউ ছাত্র সংসদের প্রেসিডেন্ট ঐশী ঘোষ-সহ সাত বামপন্থী পড়ুয়াকে প্রাথমিক ভাবে চিহ্নিত করে ফেলল তারা। এর মধ্যে আবার দুই এবিভিপি সদস্যের নামও জড়িয়ে গেল।
জেএনইউয়ে হামলার পরেই অভিযোগের আঙুল উঠেছিল আরএসএসের ছাত্র সংগঠন এবিভিপি-র দিকে। ওই হামলার একাধিক ছবি এবং এই সংক্রান্ত ‘পরিকল্পনার’ হোয়্যাটসঅ্যাপ কথোপথন ছড়িয়ে পড়ে সোশ্যাল মিডিয়ায়। পাশাপাশি দিল্লি পুলিশ এবং জেএনইউয়ের সঙ্ঘ-ঘনিষ্ঠ উপাচার্যের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। কিন্তু বিজেপি শীর্ষ নেতৃত্ব নিশানা করেন বাম ছাত্র সংগঠনগুলিকেই।
অভিযুক্ত: পুলিশের তালিকা
• চুনচুন কুমার
প্রাক্তন ছাত্র এবং আইসা কর্মী
অভিযোগ: পেরিয়ার হস্টেল লক্ষ্য করে পাথর ছুড়েছিলেন
• পঙ্কজ মিশ্র
স্কুল অব সোশ্যাল সায়েন্সেসের ছাত্র
অভিযোগ: কাপড়ে মুখ ঢাকা দলের সঙ্গে পেরিয়ার হস্টেলে চড়াও
• ঐশী ঘোষ
ছাত্র সংসদের সভানেত্রী
অভিযোগ: পেরিয়ার হস্টেলে চড়াও হওয়ায় নেতৃত্ব দিচ্ছেন
• ভাস্কর বিজয় মেক
স্কুল অব আর্টস অ্যান্ড এসথেটিক্সের স্নাতকোত্তর-ছাত্র
অভিযোগ: মুখ ঢাকা দলে শামিল
• সুচেতা তালুকদার
স্কুল অব সোশ্যাল সায়েন্সের ছাত্রী এবং এসএফআইয়ের কাউন্সিলর
অভিযোগ: মুখ ঢাকা দলে শামিল
• প্রিয়া রঞ্জন
স্কুল অব ল্যাঙ্গুয়েজ, লিটারেচার অ্যান্ড কালচারাল স্টাডিজের ছাত্রী
অভিযোগ: পেরিয়ার হস্টেলে চড়াও
• দোলন সামন্ত
স্কুল অব সোশ্যাল সায়েন্সে ছাত্রী
অভিযোগ: লাল স্কার্ফে মুখ ঢেকে দলের সঙ্গে দেখা গিয়েছে তাঁকে
• যোগেন্দ্র ভরদ্বাজ
সংস্কৃতের পিএইচডি-র ছাত্র
অভিযোগ: ৫ তারিখের হিংসায় জড়িত
• বিকাশ পটেল
কোরিয়ান ভাষায় স্নাতকোত্তর
অভিযোগ: লাঠি হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গিয়েছে
দিল্লি পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী নিত্যানন্দ রাই কার্যত এবিভিপি-কে ‘ক্লিনচিট’ দিয়ে আঙুল তোলেন বাম-কংগ্রেসের দিকে। এই অবস্থায় প্রশ্ন উঠেছিল, কতটা ‘নিরপেক্ষ’ তদন্ত করবে অমিত শাহের নিয়ন্ত্রণে থাকা দিল্লি পুলিশ? শুক্রবার দিল্লি পুলিশের সাংবাদিক বৈঠকের পরে অনেকেই বলছেন, দিল্লি পুলিশ অমিত শাহের কথাই শুনেছে।
আরও পড়ুন: দীপিকা তো কংগ্রেসের সমর্থক: স্মৃতি
তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ খারিজ করে ঐশী দিল্লি পুলিশের বিরুদ্ধেই পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ তুলেছেন। অন্য দিকে চিহ্নিত বিকাশ এবং যোগেন্দ্র ভরদ্বাজকে নিজেদের সদস্য বলে মানলেও এবিভিপি-র দাবি, পুরো তদন্তের আগে এ বিষয়ে কিছু বলা শক্ত।
পুলিশের প্রকাশিত জেএনইউ ছাত্র সংসদের সভানেত্রী ঐশী ঘোষের ছবি। এসএফআই সদস্য সুচেতা তালুকদার (ডান দিকে)। ছবি: পিটিআই।
রবি সন্ধ্যায় ক্যাম্পাসে তাণ্ডবের পরেই এবিভিপি দাবি করেছিল, সে দিন সকালে পেরিয়ার হস্টেলে জেএনইউ ছাত্র সংসদের প্রেসিডেন্ট ঐশী ঘোষের নেতৃত্বে যে হামলা হয়েছিল, তাতে আহত হয়েছেন তাদের ৭-৮ জন সদস্য। উপাচার্য এম জগদেশ কুমারও প্রথম থেকেই হিংসার দায় বামপন্থী ছাত্র সংসদের ঘাড়ে চাপিয়ে দেন। সেই সঙ্গেই দাবি করেন, রবিবার সন্ধ্যার তাণ্ডবের শিকড় আসলে সিমেস্টার পরীক্ষার জন্য অনলাইন নথিভুক্তি রুখতে ১ ও ৪ জানুয়ারি আন্দোলনকারীদের সার্ভার রুম তছনছ করা থেকে। ওই ঘটনায় ঐশী-সহ ২০ জনের নামে এফআইআর করেন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। সেটা অবশ্য রবিবার তাণ্ডবের পরে! নিজেদের বক্তব্যের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে পেরিয়ার হস্টেলে ‘হামলার ভিডিয়ো প্রমাণ’ এবিভিপি ছড়িয়ে দেয় সোশ্যাল মিডিয়ায়। শুক্রবার এবিভিপি-র সেই অভিযোগের কথাই বার বার উল্লেখ করে সাংবাদিক বৈঠক করে দিল্লি পুলিশ! সেখানে ন’জনকে চিহ্নিত করার কথা জানান পুলিশের বিশেষ তদন্তকারী শাখার প্রধান জয় তিরকে। পুলিশের দাবি, সন্ধ্যার ঘটনার ভিডিয়ো পাওয়া না-গেলেও সোশ্যাল মিডিয়ায় পাওয়া ফুটেজ থেকে কয়েক জনকে চিহ্নিত করা গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়া এবং শিক্ষকদের একাংশের আশঙ্কা, হামলার সময়ে দীর্ঘ ক্ষণ ক্যাম্পাসে আলো বন্ধ ছিল। তার উপরে ওই ঘটনার সিসিটিভি ফুটেজ নষ্টের চেষ্টা হতে পারে। যে কারণে ফুটেজ সংরক্ষণের দাবিতে এ দিন দিল্লি হাইকোর্টে জনস্বার্থ মামলা করেছেন জেএনইউয়ের তিন অধ্যাপক।
দিল্লি পুলিশের অভিযোগ প্রসঙ্গে ঐশী বলেন, ‘‘আমার উপরে যে হামলা চালানো হয়েছিল, আমার কাছে তার প্রমাণ আছে। আমরা কোনও অন্যায় করিনি। কয়েকটি ছবি থেকে কিছু প্রমাণ হয় না। লাঠি বা রড হাতে কারও উপরে কোনও প্রাণঘাতী হামলার চেষ্টা আমি করিনি। তাই পুলিশকে ভয় পাওয়ার প্রশ্ন নেই। শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক পথে আন্দোলন চলবে।’’ দেশের আইন ব্যবস্থার উপরে পূর্ণ আস্থা আছে জানিয়েও তাঁর অভিযোগ, ‘‘দিল্লি পুলিশ পক্ষপাতিত্ব করছে কেন? তারা আমার অভিযোগকে তো এফআইআর হিসেবে দায়ের পর্যন্ত করেনি। মুখোশ পরে কোনও ভাঙচুর আমি চালাইনি। বরং আমার উপরেই হামলা হয়েছে।’’
৫ জানুয়ারি ঐশী ঘোষদের উপর হামলার রাতে হামলাকারীদের যে ছবি ভাইরাল। যদিও পুলিশ এই মুখোশধারীদের কথা কিছুই বলেনি।পুলিশের প্রকাশিত ছবিতে দোলন সামন্ত। শুক্রবার নয়াদিল্লিতে (ডান দিকে)। ছবি: পিটিআই।
ঐশীর এই প্রশ্নগুলোই গত কয়েক দিনে অসংখ্য বার উঠেছে। অনেকেরই প্রশ্ন, সার্ভার রুম ভাঙচুরের যে ঘটনা ১ এবং ৪ জানুয়ারি ঘটেছিল, তার এফআইআর ৫ জানুয়ারি তাণ্ডবের পরে কেন নথিবদ্ধ করা হল? কেনই বা এবিভিপি, বিজেপি, উপাচার্য এবং পুলিশ মূলত সার্ভার রুম ভাঙা এবং রবিবারের সকালের ঘটনার কথা বার বার বলছে, অথচ এড়িয়ে যাচ্ছে সন্ধ্যার তাণ্ডবের কথা? কেন প্রাথমিক ভাবে যে নয় অভিযুক্তের ছবি প্রকাশ করা হয়েছে, সেখানে শেষ দু’জনের নামের সঙ্গে এবিভিপি-র উল্লেখ নেই? অথচ ঐশী ও চুনচুন কুমারের পরিচয়ে উল্লেখ করা হয়েছে তাঁদের রাজনৈতিক যোগের কথা।
জেএনইউএসইউয়ের অভিযোগ, তদন্তে পক্ষপাতিত্ব আছে বলেই সাংবাদিকদের সামনে এবিভিপি-র নাম উল্লেখ করা হয়নি। শিব পূজন মণ্ডলের ছবি চিহ্নিত করা হয়েছে বিকাশ পটেলের ছবি হিসেবে। সব মিলিয়ে, অমিত শাহ এবং উপাচার্যের কথাই এ দিন ফের বলেছে পুলিশ।
মানবসম্পদ উন্নয়ন সচিব অমিত খারের সঙ্গে বৈঠকের পরে সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি ঐশী ঘোষ। শুক্রবার নয়াদিল্লিতে। ছবি: পিটিআই।
দিল্লি পুলিশের দাবি নিয়ে মাঠে নেমে পড়েছেন রবিশঙ্কর প্রসাদ, প্রকাশ জাভড়েকর, স্মৃতি ইরানি-সহ বিজেপির একাধিক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী। তাঁদের বক্তব্য, জেএনইউয়ে গণ্ডগোলের পিছনে আসল ভূমিকা যে বামপন্থী ছাত্র সংগঠনগুলিরই, তা এখন স্পষ্ট। এ নিয়ে করা স্মৃতির টুইটকে রিটুইট করেছে অমিত শাহের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। কংগ্রেস নেতা অজয় মাকেনের বক্তব্য, অমিত শাহ বলেছিলেন বদলা নিতে হবে। তার পরে তাণ্ডব চালিয়েছে বহিরাগতরা। এর পরে উপাচার্য এবং দিল্লির পুলিশ কমিশনারের ইস্তফা দেওয়া উচিত। অভিযোগ উঠেছে, অমিত শাহকে তুষ্ট করতেই তদন্ত করছে দিল্লি পুলিশ।