বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছিল তখন। ঘড়িতে রাত ৯টা বেজেছে। হঠাৎ প্রচণ্ড ঝাঁকুনি দিয়ে থেমে গেল ট্রেনটা। আমি ছিলাম গার্ড-রুমে। বিপদ বুঝে দ্রুত নামলাম ট্রেন থেকে। যাত্রী কামরায় উঠে এগোতে থাকি সামনের দিকে। আতঙ্কিত যাত্রীরা ঘিরে ধরে অনেক প্রশ্ন করছিলেন। কোনও মতে তাঁদের ভিড় সরিয়ে এগিয়ে গেলাম।
ইঞ্জিনের কাছে পৌঁছতেই সব কিছু গুলিয়ে গেল। সামনেই সুড়ঙ্গ। দুরন্ত জলস্রোত বইছে সেখানে। আশপাশে পড়ে রয়েছে বড় পাথরের চাঁই। আর সেগুলির সঙ্গে সংঘর্ষে বেলাইন হয়ে গিয়েছে ট্রেনের ইঞ্জিনটা!
দিল্লি-শিলচর পূর্বোত্তর সম্পর্কক্রান্তি এক্সপ্রেসে চড়েছিলাম গত কাল দুপুরে। লামডিং থেকে। নির্ধারিত সময়ের কিছুটা দেরিতে চলছিল ট্রেন। নিউ হাফলং পর্যন্ত ভালই এগোই। ডাইভারসন অংশও নির্বিঘ্নে পেরিয়ে গেলাম। রাত ৯টা ২ মিনিটে এসে দাঁড়াই ডিটকছড়ায়। ট্রেন তিন মিনিট দাঁড়ায় সেখানে। পরবর্তী স্টেশন বান্দরখাল।
কিছুটা এগোতেই চালক কানুচন্দ্র দাস দেখতে পান, লাইনের উপর দিয়ে জল বইছে। সতর্ক হয়ে যান তিনি। কিন্তু সুড়ঙ্গে ঢোকার মুখে তাঁর নজরে পড়ে, ভিতরে প্রচুর জল। সামনেই পড়ে রয়েছে বিশাল পাথরের চাঁই। দ্রুত ব্রেক কষেছিলেন। তবু সেই পাথরে গিয়ে লাগে ইঞ্জিনের সামনের অংশ। প্রথম দু’টি চাকা লাইন থেকে নেমে যায়। দুর্ঘটনাস্থল লামডিং থেকে ১২৯ কিলোমিটার ২০০ মিটার দূরে।
ঝাঁকুনির পর আশঙ্কায় পড়ে গিয়েছিলাম— যাত্রিবাহী কামরাও যদি ছিটকে যায়। তা হলে চরম অসহায় অবস্থায় পড়তে হবে। তবে তেমন কিছু হয়নি বুঝতে পেরে স্বস্তি ফেরে। সুড়ঙ্গের ভিতরে শুধু ইঞ্জিন ও মালপত্র বহনের একটি কামরা ঢুকেছিল (এসএলআর)। বাইরে দাঁড়ানোর উপায় ছিল না এমন জলধারা। সুড়ঙ্গের ভিতরে যাই হোক, বাইরে জলের সঙ্গে পাহাড় থেকে নাগাড়ে পাথর নামছে। কী করি! ছোট পাথর বলে লাইনের উপর ট্রেন তবু এতক্ষণ দাঁড়িয়ে রয়েছে। একটা বড় পাথর ছুটে এলেই মহাবিপদ। ট্রেনের কামরাগুলি যে কোথায় ছিটকে যাবে! তাড়াতাড়ি বেলাইন ইঞ্জিনকে কামরা থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে দিই।
কাজটা মোটেও সহজ ছিল না। কাকে তখন ডাকাডাকি করব! শেষ পর্যন্ত হুক খুলে ইঞ্জিন-কামরা আলাদা করা সম্ভব হল। পিছন দিকের ইঞ্জিনে ছিলেন এম গগৈ। তাঁকে বললাম, খুব ধীরে হাঁটার গতিতে ডিটকছড়ায় ট্রেন ফিরিয়ে নিতে। কারণ এমন জলস্রোতে এত বড় ট্রেন নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বড় ঝুঁকির। রাত ১০টা ১০ মিনিটে উল্টোপথে রওনা হই।
তখন খেয়াল হল, এমন একটা সিদ্ধান্ত একাই নিয়ে নিলাম! এ বার কী হবে! সকলকে মেসেজ পাঠাতে শুরু করি। কিছু ক্ষণ পরে জেনারেল ম্যানেজার এইচ কে জাগ্গি ফোন করলেন। সব খবরাখবর নিয়ে জানতে চাইলেন, ডিটকছড়া ফিরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত আমাকে কে দিয়েছিলেন। গলা শুকিয়ে কাঠ হওয়ার জোগাড়। এমনিতেই এত সময় কী-ই না ধকল গেল। জিভ থেকে কথা সরছিল না। ভয়ে ভয়ে বললাম, পরিস্থিতির চাপে নিজেই সিদ্ধান্তটা নিয়ে ফেলি। খুব তারিফ করলেন জেনারেল ম্যানেজার। বললেন, অভিজ্ঞতার জন্যই আমি এমন একটা সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছি।
তত ক্ষণে অবশ্য জানাজানি হয়ে গিয়েছে দুর্ঘটনার কথা। ডিটকছড়া এসে দেখি, সেনা জওয়ানদের স্টেশন চত্বরে মোতায়েন করা হয়েছে। ফলে নিরাপত্তা নিয়ে যাত্রীদের আর আশঙ্কা রইল না। আজ সকাল ৮টা ৫৫ মিনিটে বিভাগীয় নির্দেশে ফের রওনা হই শিলচরের উদ্দেশে। ওই সুড়ঙ্গমুখে এসে দেখি, বিপদ কেটে গিয়েছে। প্রচুর নির্মাণকর্মী দাঁড়িয়ে রয়েছেন। তবু অত্যন্ত ধীরগতিতে ওই জায়গা পেরনো হয়। দুপুর সাড়ে ১২টায় সবাইকে নিয়ে নিরাপদে শিলচর পৌঁছে যাই।