গালে কাঁচাপাকা দাড়ি। মাথায় ফেজটুপি। বয়স বছর পঞ্চাশেক। মুখে চোস্ত ইংরেজি, আবার কোনও কিছুর ব্যাখ্যায় প্রয়োজনে মুম্বইয়া বুলি। ধর্মপ্রচারক জাকির নাইককে এত দিন এ ভাবেই টিভিতে ইসলামের গুণগান করে আসতে দেখেছে আমজনতা। বিভিন্ন সময়ে অভিযোগ উঠেছে, তিনি নাকি ধর্মপ্রচারের নামে সন্ত্রাসের প্রচার ঘটান। কট্টরপন্থী বক্তব্যের জন্য ব্রিটেন বা কানাডায় তাঁর প্রবেশ নিষিদ্ধ হলেও ভারতে কিন্তু তিনি দিব্যি ছিলেন।
কিন্তু বাদ সাধল গুলশন। তদন্তে দেখা গিয়েছে, পাঁচ জঙ্গির মধ্যে দুই তরুণ নাকি ভীষণ ভাবে অনুপ্রাণিত ছিল জাকির নাইকের ভাবধারায়। এমনিতেই জাকিরের পিস চ্যানেল বাংলাদেশে ভীষণ জনপ্রিয়। তাই তদন্তে দুই তরুণের বিষয়ে জানার পরেই বাংলাদেশ সরকার নাইকের পিস চ্যানেলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য নয়াদিল্লিকে অনুরোধ জানায়। বাংলাদেশের অনুরোধ মেনে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক জানিয়েছে, ইতিমধ্যেই জাকিরের বিভিন্ন ধর্মপ্রচার সংক্রান্ত ভিডিওগুলি খতিয়ে দেখা শুরু করেছে তারা।
জাকিরের কর্মকাণ্ড মুম্বইভিত্তিক হওয়ায় আজ মহারাষ্ট্রের দেবেন্দ্র ফডনবিশ সরকার জাকিরের বিরুদ্ধে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বেঙ্কাইয়া নায়ডু জানিয়েছেন, জাকিরের বেশ কিছু চরম আপত্তিজনক ভিডিও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক খতিয়ে দেখছে। বাংলাদেশি যুবকদের প্রভাবিত করার অভিযোগ ওঠার পর নিজের সাফাইতে জাকির বলেছেন, ওই দেশের ৯০ শতাংশ মানুষ আমায় চেনে। তাদের মধ্যে ৫০ শতাংশ হল আমার ভক্ত। আমি যা বলি সবাই কিন্তু তার সবটা মেনে চলে না। আমি সবসময় সাধারণ নিরীহ মানুষের হত্যার বিপক্ষে।’’
আরও পড়ুন: ইদের জমায়েত থেকে সন্ত্রাসের তীব্র নিন্দা করলেন দু’দেশের ইমামরা
শুধু গুলশনই নয়, সম্প্রতি জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা বা এনআইএ হায়দরাবাদে আইএস মডিউল ক্র্যাক করে। সূত্রের খবর, ওই মডিউলের মাথা মহম্মদ ইব্রাহিম ইয়াজদানি। সে তদন্তে স্বীকার করে, শরিয়ত প্রতিষ্ঠার জন্য সশস্ত্র সংগ্রামের অনুপ্রেরণার পিছনে রয়েছে জাকিরই। এর আগেও একাধিক বার বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছেন জাকির। তবে এই জাকির কিন্তু আইএস-এর ভাবধারার সঙ্গে নিজের দূরত্ব বজায় রাখলেও ওসামা বিন লাদেনকে জঙ্গি বলে মনে করতেন না। অভিযোগ, একটি ভিডিও বার্তায় জাকির বলেন, প্রত্যেক মুসলমানের উচিত ওসামা বিন লাদেনের মতো হওয়া। যদিও বিষয়টি নিয়ে পরে বিতর্ক হওয়ায় তিনি দাবি করেন, তার ভিডিওতে কারসাজি করা হয়েছে। তিনি ওই কথা বলেননি।
ভারতে তাঁর টিভি চ্যানেলের উপরে কড়াকড়ি না থাকলেও ব্রিটেন কানাডার মতো দেশগুলি বহু আগেই পিস চ্যানেলের সম্প্রসারণে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল। শুধু তাই নয়, জাকিরকে ওই সব দেশ ভিসা দেওয়ার প্রশ্নেও নিষেধাজ্ঞা জারি করে রেখেছে। বেশ কিছু আন্তর্জাতিক এজেন্সি মনে করে, জাকিরের বক্তব্য সন্ত্রাসে যোগ দেওয়ার জন্য যুবকদের মগজধোলাই করতে সাহায্য করে। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ভারত ছাড়াও বিভিন্ন দেশে যে সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ হয়েছে, সেই সব জঙ্গি স্বীকার করেছে তারা জাকির নাইকের বক্তৃতা শুনে উদ্বদ্ধু হয়েছে। যেমন নাজমুল্লা জাজি। এই আফগান আমেরিকান গত বছর নিউইয়র্ক সাবওয়েতে আত্মঘাতী বিস্ফোরণ ঘটাতে গিয়ে ধরা পড়ে। জাকিরের একনিষ্ঠ অনুগামী ছিল এই জাজি। বেঙ্গালুরুর বাসিন্দা কাপিল আহমেদ গ্লাসগো বিামনবন্দর বিস্ফোরণ ঘটিয়ে আহত হয়ে ধরা পড়ে। তদন্তে সে জানায়, তার এই পথে আসার জন্য দায়ী জাকিরের বক্তব্যই।
এরই পাশাপাশি ঘরোয়া রাজনীতিতে জাকির বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছেন কংগ্রেসের বর্ষীয়ান নেতা দ্বিগ্বিজয় সিংহ। একটি ভিডিওতে দেখা গিয়েছে, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা সংক্রান্ত একটি মঞ্চে দ্বিগ্বিজয়কে আলিঙ্গন করতে দেখা যায় জাকিরকে। ভিডিওতে দ্বিগ্বিজয়কে জাকিরের প্রশংসায় বলতে শোনা যায় যে তার মতো লোকেরাই হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে যে আস্থার অভাব রয়েছে তা দূর করতে পারেন। এখন জাকিরের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠার পরে স্বভাবতই রাজনৈতিক ভাবে দ্বিগ্বিজয়কে আক্রমণ শানিয়েছেন বিজেপি নেতৃত্ব। জবাবে কংগ্রেসের ওই ক্ষুব্ধ নেতা জানান, “ জাকিরের বিরুদ্ধে সত্যি কোনও অভিযোগ থাকলে সরকার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিক।”