বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের প্রতিবাদে রবিবার মানিকতলা অঞ্চলে বিক্ষোভ মিছিল। ছবি: সুমন বল্লভ।
বাংলাদেশে শেখ হাসিনা পরবর্তী অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতার আসার পরে নয়াদিল্লি ঢাকার প্রথম সামগ্রিক এবং গুরুত্বপূর্ণ দ্বিপাক্ষিক বৈঠক বসছে সোমবার। তার আগে আলোচনায় উঠে এল কেন্দ্রের একটি ১১ পাতার অভ্যন্তরীণ সমীক্ষা রিপোর্ট। যেখানে বলা হচ্ছে, বর্তমানে সে দেশে যে ভাবে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা এবং চরমপন্থার বাড়বৃদ্ধি ঘটছে, সেই প্রেক্ষিতে নিজেদের সংশোধনের জন্য আট বছর আগে ঢাকায় ঘটা ‘হোলি আর্টিজ়ান’ জঙ্গি হামলার ঘটনাটিকে ফিরে দেখা প্রয়োজন ইউনূস সরকারের।
কেন্দ্রীয় সূত্রে জানানো হয়েছে, বিদেশসচিব বিক্রম মিস্রীর সোমবারের ঢাকা সফরে সে দেশে সংখ্যালঘু নিরাপত্তার বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। অন্য দ্বিপাক্ষিক বিষয়গুলি উত্থাপনের আগেই ভারতের তরফ থেকে বলা হবে, বাংলাদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তার দায়িত্ব সে দেশের সরকারের। সে দেশে হিংসা রাস্তায় নেমে এসেছে। আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থার দ্রুত উন্নতি না করতে পারলে আলোচনা কূটনৈতিক দৌত্য ফলপ্রসূ হবে না।
পাশাপাশি ওই সমীক্ষা রিপোর্টে (‘উত্তেজনা থেকে সন্ত্রাস— বাংলাদেশে মৌলবাদের ঢেউ’) বলা হচ্ছে, ‘যে ভাবে বাংলাদেশে ঘটনার গতি এগোচ্ছে, তাতে খুব বেশি সংশয় থাকার কথা নয় যে, বাংলাদেশের সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন চরমপন্থী মৌলবাদী ইসলামিক সংগঠনের প্রভাব বাড়ছে। গোটা দেশের বিভিন্ন স্থানে অল্পবয়সিরা যে ভাবে হিংসার চরমপন্থা নিয়ে চলছে, তা দেখছে গোটা বিশ্ব।’ রিপোর্টের বক্তব্য, লুটপাটের প্রবণতা, শিক্ষাব্যবস্থায় নানা ভাবে কলকাঠি নাড়া, সমাজমাধ্যমকে চরমপন্থী করে তোলা এবং জঙ্গি সংগঠনগুলির উত্থানের কারণে বেশ কয়েক বছর ধরেই বাংলাদেশের জল ঘোলা হচ্ছিল। দেশের ধর্মনিরপেক্ষ কাঠামো চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছিল ক্রমাগত। এই প্রবণতা একদিকে যেমন দেশের বহুত্ববাদী পরিচয়কে চাপের মধ্যে ফেলেছে, তেমনই আগামী দিনে বাংলাদেশের রাজনৈতিক এবং সামাজিক সুস্থিতিকে ভিতর থেকে ক্ষয় করেছে। ক্ষমতার হাত বদলের পর মৌলবাদী ইসলামিক সংগঠনগুলি বাংলাদেশের সমাজ এবং প্রশাসনের প্রতিটি ক্ষেত্রে নিজেদের প্রভাব কায়েম করার চেষ্টা করছে। বাংলাদেশকে মৌলবাদী রাষ্ট্রে পরিণত করার প্রাথমিক অস্ত্র হল ধর্ম। বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতীক মূর্তি ভাঙার সাম্প্রতিক ঘটনা থেকেই স্পষ্ট, সে দেশে মৌলবাদের বাড়বাড়ন্ত ঘটছে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার সময়ও সে দেশের বহুত্ববাদী পরিচয় এবং বাংলাদেশিদের মধ্যে প্রবল প্রভাব থাকা মোল্লাতন্ত্রের মধ্যে ভারসাম্য রাখতে গিয়ে হিমশিম খেয়েছে।'
এরপরই ওই সমীক্ষা রিপোর্টে ২০১৬ সালের হোলি আর্টিজ়ান কাফেতে হামলার প্রসঙ্গ তুলে বলা হয়েছে, ‘ওই ঘটনার পর হাসিনা সরকার বাংলাদেশের সন্ত্রাসবাদী এবং মৌলবাদী সংগঠনগুলির বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়েছিল। তৈরি করেছিল অ্যান্টি টেররিজ়ম ইউনিট (এটিইউ)। এর পর বহু জঙ্গি গ্রেফতার হয়েছে, অনেক সন্ত্রাসবাদী সংগঠনকে ধ্বংস করা হয়েছে।’
২০১৭ সালে ‘বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিয়োরিটি স্টাডিজ়’-এর করা একটি সমীক্ষা রিপোর্ট তুলে ধরে বলা হচ্ছে, সে দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে ধর্মীয় মৌলবাদের চাষআবাদ শুরু হয়েছিল গত দশক থেকেই। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলি আলাদা করে আতস কাচের তলায় আসে হোলি আর্টিজান কাণ্ডের পর। সেখানে হামলাকারীরা সে দেশের নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে মৌলবাদে দীক্ষিত হয়েছিল। ওই জঙ্গি হামলার ঘটনা বাংলাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি সম্পর্কে উদ্বেগ তৈরি করে।
রিপোর্টে বলা হচ্ছে, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বাংলাদেশে যে গণহারে লুঠপাট, ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে, তার অন্যতম নিশানা হয়ে উঠেছে সাংস্কৃতিক এবং ঐতিহাসিক মিনার ও সৌধগুলি। ঢাকা এবং অন্যান্য শহরে কম বেশি দেড় হাজার মূর্তি,ম্যুরাল, সৌধ ভাঙচুর করা, অগ্নি সংযোগ করা হয়েছে এই বছরের অগস্ট মাসের ৫ থেকে ১৪ তারিখের মধ্যে। হিসাব দেখিয়ে বলা হচ্ছে, ঢাকা ডিভিশনে এ রকম ২৭৩টি মিনার ও সৌধ, চট্টগ্রামে ২০৪টি, রাজশাহিতে ১৬৬, খুলনায় ৪৭৯টি, বরিশালে ১০০টি, শ্রীহট্টে ৪৯টি এবং ময়মনসিংহে ৯২টি মূর্তি ও সৌধে ভাঙচুর করা হয়েছে।