আমার আস্তাবলে নানা ঘোড়া রয়েছে— বিএমডব্লিউ, টয়োটা লেক্সাস, জ্যাগুয়ার। আমার ফেভারিট কিন্তু মার্সেডিজ। তাই মেয়ে যখন চাইল, না বলতে পারিনি। কথাটা বলেছিলেন পুণের এক শিল্পপতি যিনি অন্যান্য সামগ্রীর সঙ্গে পানের মশলাও তৈরি করেন। গত বছর সেই মার্সেডিজ-মেব্যাক গাড়ির দাম ছিল ৫.৬ কোটি। এটা কিন্তু মেব্যাকের সবচেয়ে দামী মডেল নয়। তার দাম ১০.৫ কোটি। একেবারে টপ অফ দ টপ।
মার্সেডিজ যে সবার পছন্দ তা কিন্তু নয়। যাদের বয়স কম, যারা স্পিড পছন্দ করে তাদের জন্য আছে ফেরারি মাসেরাতি বা ল্যাম্বরগিনি। যারা ট্র্যাডিশনের ভক্ত তারা কিনছে রোলস-রয়েস বা বেন্টলি। সব ব্র্যান্ডের চোখ এখন ভারতের উপর। প্রতি বছর সব মিলিয়ে ৩৪ হাজার লাক্সারি গাড়ি বিক্রি হচ্ছে ভারতে। আর প্রাইভেট জেট? ২০০০ সালে ভারতে ছিল ১৩৪টি। ২০১৫ সালে এই সংখ্যা হয় ৪৮৭। একশোর বেশি কোম্পানি এই জেট চালায় এবং ভাড়া দেয়। ভাড়া ঘণ্টায় ২ লক্ষ টাকা। তাতে যাত্রীর পকেটে খুব একটা চাপ পড়ে বলে মনে হয় না। এমনও হয় যে দিল্লি-মুম্বই ফ্লাইটের জন্য জল আনিয়ে দিতে হয় বিলেত থেকে।
কারা কিনছেন এই গাড়ি? কারা উড়ছেন জেটে? বিত্তবান এবং অতি-বিত্তবান ভারতীয়। বিত্তবান তাঁরা যাঁদের সম্পত্তির পরিমাণ অন্তত ১০ লক্ষ ডলার। অতি-বিত্তবান হলেন তাঁরা যাঁদের সম্পত্তি অন্তত তিন কোটি ডলার। গত পাঁচ বছরে এদের সংখ্যা বেড়েছে গড়ে ১৬.৫%। এদের সংখ্যা অনুযায়ী পৃথিবীতে ভারতের স্থান চতুর্থ। শুধু তাই নয়। ১০০ কোটি ডলারের বেশি যাঁদের সম্পত্তি, ইংরেজিতে যাঁদের বলে বিলিয়নেয়ার- তাঁদের এক চতুর্থাংশ এখন ভারতীয়। সম্প্রতি প্রকাশিত ইফপ্রি-র ‘ওয়ার্ল্ড হাঙ্গার রিপোর্ট’ দেখে যাঁরা চোখের জল ফেলেছিলেন তাঁরা আশ্বস্ত হতে পারেন।
বাজেটের সময় এসে গেল। আবার প্রশ্ন উঠবে আচ্ছে দিন কি এল? আদৌ আসবে কি? অর্থমন্ত্রীর বাজেট কতটা ত্বরান্বিত করবে দেশের উন্নয়ন? যাঁরা এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজবেন তাঁরা তাকাবেন সাধারণ মানুষের দিকে। কৃষকের দিকে। তাই স্বাভাবিক। কারণ আমাদের দেশের বেশির ভাগ মানুষ গরিব, কৃষিনির্ভর। তা ছাড়া কৃষক বিক্ষোভ দেখা গেছে ব্যাপক ভাবে। প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন গ্রামাঞ্চলের মানুষের আয় দ্বিগুণ করা হবে। কিন্তু শুধুমাত্র গরিব মানুষের দিকে তাকানো ব্যবহারিক অর্থে যতই গ্রহণযোগ্য হোক, তত্ত্বের দিক থেকে তা অসম্পূর্ণ। তাই ভুল। এই আলোচনায় আমরা চেষ্টা করব ধনীদের ব্যাপারটা বুঝে নিতে। ধনী মানুষের সংখ্যা বাড়ছে ভাল কথা। তাঁদের মোট সম্পত্তিও কি বাড়ছে? কী হারে? গাড়ির বাজারটা আমরা দেখলাম। এ বার খবর নিতে হবে অন্যান্য বাজারের।
গাড়ির পরেই আসে বাড়ির কথা। ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হওয়ার আগে ভারতে দুটো বিলাসবহুল বাড়ি তৈরির প্রকল্প হাতে নিয়েছিলেন। পুণের প্রকল্পের কাজ সম্পূর্ণ হয়েছে। ২২তলার দুটি টাওয়ারে ৬০০০ বর্গফুটের ৪৪টি ফ্ল্যাট। ফ্ল্যাটের দাম ১৫ কোটি থেকে শুরু। মার্বেল এসেছে ইতালি থেকে। রান্নাঘর জার্মানির। জন অ্যাব্রাহাম ব্র্যান্ডের জিম আছে ক্লাবে। সব ফ্ল্যাট বিক্রি হয়ে গেছে। মুম্বইয়ে তৈরি হচ্ছে একটি ৭৫তলা টাওয়ার। ৩-৪ কামরার ফ্ল্যাটগুলির সব বেডরুম থেকেই সমুদ্র দেখা যাবে। একটু ভাল ভাবে বাঁচার জন্য যা যা দরকার, যেমন রোলস রয়েস বা ছোট জেট ভাড়া করা, সব ব্যবস্থাই থাকবে বাড়ির মালিকদের জন্য।
চিরকাল কেউ বাড়িতে বসে থাকে না। ছুটিছাটায় বেরিয়ে পড়া আমাদের অভ্যাস। লন্ডন, নিউ ইয়র্কে সবাই যায় তাই প্রকৃত ধনী লোক এই শহরগুলি এড়িয়ে চলেন। তা ছাড়া ৫০০-৬০০ কামরার বিশাল হোটেলে প্রিভেসি বলে কিছু থাকে না। তাই ছুটি কাটাতে তাঁরা ভিড় জমাচ্ছেন ‘এক্সক্লুসিভ’ লোকেশনে। বাহামায় কোনও এক ছোট দ্বীপে বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে এক সপ্তাহ কাটিয়ে আসতে পারেন। ভয় নেই। আমাদের কারও সঙ্গে দেখা হবে না। খরচ পড়বে প্রায় তিন কোটি টাকা। কেনিয়ায় চলে যান। জেব্রা হাতি বা গণ্ডার দেখতে বাড়ি ছেড়ে বেরতে হবে না। ফরাসি শেফের হাতের রান্না খাবেন। ১৪ জনের জন্য খরচ হবে মাত্র ১.৪ কোটি। একই রকমের সুযোগ এখন মিলছে আন্দামানে বা মলদ্বীপে। বিলিতি কোম্পানি আসছে ভারতীয়দের খিদমত করতে।
আমাদের ছেলেমেয়েরা যেমন ইউরোপে যায় বিয়ে করতে, ওরা চায় রাজস্থানের প্রাসাদ ভাড়া করে রাজকীয় বিবাহানুষ্ঠান। শুনেছি প্যাকেজ ডিল পাওয়া যায় দু’কোটি টাকার মধ্যে। অবশ্য আপনি কন্যাকে যে হিরেটা দেবেন তার দাম হবে বেশি। সেটা যে জয়পুরে কিনতে হবে তা-ও নয়। আমাদের লোকেরা লন্ডন নিউ ইয়র্কে জুয়েলারির দোকান চালাচ্ছে। সেখানেই পাবেন যা খুঁজছেন। আর দেখা হয়ে যাবে অ্যাঞ্জেলিনা জোলি বা নিকোল কিডম্যানের সঙ্গে।
যদি হঠাৎ ইচ্ছা হয় বাইরে খাওয়ার? তার জন্য আছে রেস্তোরাঁ অথবা ক্লাব। দুটোতেই ইদানীং অনেক উন্নতি হয়েছে। পাঁচ তারা হোটেলের রেস্তোরাঁ তো আছেই। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে ছোট ‘বুটিক’ রেস্তোরাঁ। পরীক্ষানিরীক্ষা চলছে ভারতীয় রান্নার সঙ্গে ইউরোপীয় টেকনিকের মিশ্রণ নিয়ে। বাংলা রান্না কী ভাবে প্লেটে সাজানো যায় তা নিয়ে। ক্যালকাটা ক্লাব জিমখানা ক্লাবের রাজত্ব শেষ। এখন শুনবেন ইকুয়াস রেজিস অথবা ফোর সিজন্সের নাম। দশ লক্ষ টাকা ডিপোজিট, কিন্তু দু’মাসেই আড়াইশো সদস্য।
ভুলেও ভাববেন না যে বিলাসিতা স্থূল মস্তিষ্কের বা বিকৃত রুচির পরিচয়। ঈশ্বর যাঁদের অর্থের ভাণ্ডার দিয়েছেন তাঁদের রুচিও দিয়েছেন। আমাদের রাজ্যেও আমরা দেখেছি একটি পেন্টিং এক কোটি ৮০ লক্ষ টাকায় বিক্রি হতে। দিল্লি মুম্বইয়ে আর্টের বাজার আরও সমৃদ্ধ। গাঁধীজির সই করা বই বিক্রি হয়েছে তিন লক্ষ টাকায়। ভারতে শ্যাম্পেন তৈরি হচ্ছে অনেক দিন হল। এখন সিঙ্গল মল্ট তৈরি করছি আমরা। সঙ্গ দেওয়ার জন্য পাবেন হাভানা চুরুট এবং নিখুঁত মিউজিক সিস্টেম।
মনে করার কারণ আছে যে দেশের ধনী মানুষ ভালই আছেন। তবে তাঁদের প্রশ্ন করলে তাঁরা নিশ্চয়ই হাজারো সমস্যার কথা বলবেন। লাক্সারি গাড়ির বিক্রি বাড়ছে না। ট্যাক্স কমানো যায় না কি? প্রায় চার হাজার বিলাসবহুল ফ্ল্যাট পড়ে আছে। বিক্রি হয়নি। এ ভাবে চললে বিনিয়োগ আসবে? আর্টের সমঝদার বলছেন ভারতের আর্টের বাজারে বিরাট বৃদ্ধি সম্ভব। কোনও কারণে তা হচ্ছে না। জরুরি ভিত্তিতে দেখা দরকার।
যাঁদের চোখে এখনও সোশ্যালিজমের পুরনো চশমা লাগানো তাঁরা বলবেন এই বিলাসিতা অর্থের অপচয়। ভারতের মতো দরিদ্র দেশে এর স্থান নেই। আমরা দেখতে চাই অর্থমন্ত্রী কঠোর ব্যবস্থা নিয়েছেন এই অপচয় বন্ধ করার। ২৮% কেন, ৫৬% কর চাপানো হোক বিলাসের সামগ্রীর উপর। সরকারি ব্যাঙ্ক ১২ লক্ষ কোটি টাকার ঋণ আদায় করতে পারছে না। এই দুর্নীতি তিনি সহজেই মেনে নেবেন কেন? অনাদায়ী ঋণের বোঝা এত দিন বয়েছে করদাতা। এখন তা ক্ষুদ্র সঞ্চয়কারীর উপর চাপানো হবে?
কর্পোরেট ট্যাক্স ধাপে ধাপে কমিয়ে আনা হল। ব্যবসায়ীদের সুবিধা দেওয়ার জন্য আমরা এক পায়ে খাড়া। রাজ্যগুলির মধ্যে কম্পিটিশন লেগে গেছে বিনিয়োগ টানার। কত বিনিয়োগ হল? হিসেব নিতে হবে না? কালো টাকা বিদেশ থেকে ফিরিয়ে আনা তো দূরের কথা, কালো টাকার বিদেশে পাচার বন্ধ করতে পেরেছি আমরা?
অর্থমন্ত্রী কী বলবেন জানি। তিনি বলবেন অতি-বিত্তবান এবং বিত্তবান ভারতীয় আমাদের জাতীয় সম্পদ। নতুন ভারতের প্রতীক। ইউরোপ আমেরিকায় আমাদের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর। এদের সংখ্যা দ্রুত বাড়লেও আমরা চিনের তুলনায় পিছিয়ে আছি। ডোকলামের বদলা নিতে হলে আমাদের চিনকে অতিক্রম করতেই হবে। তাই আর কোথায় ছাড় দেওয়া যায় দেখছি। গুজরাত নির্বাচনে তো দেখলাম যে গ্রাম আমাদের সঙ্গে না থাকলেও শহর আমাদের সঙ্গে আছে। ভারত আমাদের সঙ্গে নেই কিন্তু ইন্ডিয়া আমাদের সঙ্গে আছে। বাজেট বক্তৃতায় এ কথা স্বীকার করা উচিত হবে না। কিন্তু মুখে যা-ই বলি না কেন কাজে আমায় করে দেখাতেই হবে।