গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ
বেলা ২টো। পর পর টুইট করতে শুরু করলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। ঐতিহাসিক দিন, ভারত সফল ভাবে গড়ে ফেলেছে ‘পরমাণু ত্রিশূল’— টুইটে দেশকে এমনই জানালেন নরেন্দ্র মোদী। লিখলেন, ‘‘যাঁরা পরমাণু শক্তির ভয় দেখান, আইএনএস অরিহন্তের সাফল্য তাঁদের জন্য উপযুক্ত জবাব।’’ খবরটা ছড়াতেই বিজয়োল্লাস শুরু হয়ে গেল ভারতীয় নৌসেনাতেও।
ভারতের তৈরি প্রথম পরমাণু শক্তিচালিত ডুবোজাহাজ (নিউক্লিয়ার সাবমেরিন) আইএনএস অরিহন্ত ভারতীয় নৌসেনায় কমিশনড হয়েছে ২০১৬ সালের অগস্টে। নিয়ম মাফিক তার আগেই এক বার লম্বা সি ট্রায়াল (সমুদ্রে যাতায়াত এবং অস্ত্র প্রয়োগ) সেরে নিয়েছিল আইএনএস অরিহন্ত। নৌসেনার হাতে চলে আসার পরে নিউক্লিয়ার সাবমেরিনটিকে পাঠানো হয়েছিস ‘ডেটারেন্স পেট্রোল’-এ। ভারতীয় জলসীমার ভিতরে এবং তা ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক জলসীমার নানা অংশ ঘুরে অরিহন্ত ফিরে এসেছে নির্দিষ্ট বন্দরে। এই দীর্ঘ মহড়ায় সমুদ্রের তলা থেকে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে প্রতিপক্ষের উপরে পরমাণু হামলা চালানোর মহড়াও অত্যন্ত সফল ভাবে সম্পন্ন করেছে নিউক্লিয়ার সাবমেরিনটি। দেশের তৈরি প্রথম পরমাণু শক্তিচালিত ডুবোজাহাজের এই সফল ডেটারেন্স পেট্রোল মহড়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, বলছে প্রতিরক্ষা মন্ত্রক। স্বাভাবিক ভাবেই নিজেদের সাফল্যে উল্লসিত নৌসেনা। উল্লসিত দেশের প্রধানমন্ত্রীও।
আইএনএস অরিহন্তের এই সফল ডেটারেন্স পেট্রোল ভারতের সামরিক বাহিনীর মর্যাদাকে অনেকটা বাড়িয়ে দিল। বলছেন প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞরা। ভারতের ‘পরমাণু ত্রিশূল’ আনুষ্ঠানিক ভাবে সম্পূর্ণ হল বলে প্রতিরক্ষা মন্ত্রক সূত্রে জানানো হচ্ছে।
আরও পড়ুন: কী কী আছে দেশের প্রথম পরমাণু ডুবোজাহাজ অরিহন্তের, দেখে নিন
পরমাণু ত্রিশূল কী?
পরমাণু ত্রিশূল হল স্থল, জল এবং অন্তরীক্ষ থেকে পরমাণু হামলা চালানোর সক্ষমতা। স্থলভাগ থেকে ব্যালিস্টিক মিসাইল ছুড়ে পরমাণু হামলা চালানোর সক্ষমতা অনেক আগেই অর্জন করেছে ভারত। পরবর্তী কালে ভারতীয় বায়ুসেনাও পরমাণু হামলা চালানোর পরিকাঠামো তৈরি করে ফেলেছে। ব্রহ্মসের মতো মহাশক্তিধর এবং পরমাণু হামলায় সক্ষম ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র বাহিনীর অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর থেকে ভারতীয় বায়ুসেনার প্রতি সমীহ আরও বেড়েছে যে কোনও প্রতিপক্ষের। এ বার ভারতীয় নৌসেনাও আনুষ্ঠানিক ভাবে সেই বিরাট স্বীকৃতি পেয়ে গেল। ফলে স্থল, জল এবং অন্তরীক্ষ— তিন অবস্থান থেকেই পরমাণু হামলা চালানোয় সক্ষম হয়ে উঠল ভারত।
বায়ুসেনার অস্ত্রভাণ্ডারের অন্যতম হাতিয়ার সুখোই যুদ্ধবিমান। —ফাইল ছবি
আমেরিকা, রাশিয়া, চিন, ব্রিটেন, ফ্রান্স— এই পাঁচ দেশের হাতে পরমাণু ত্রিশূল রয়েছে বলে সাধারণ ভাবে মনে করা হয়। তবে চিন, ব্রিটেন এবং ফ্রান্সের পরমাণু ত্রিশূলের সক্ষমতা নিয়ে প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞদের সংশয়ও রয়েছে। স্থল, জল, অন্তরীক্ষের মধ্যে যে কোনও জায়গা থেকে পরমাণু হামলা চালানোর সক্ষমতা চিন, ব্রিটেন বা ফ্রান্সের রয়েছে বলে অনেকেই মনে করেন না। পুরোদস্তুর ‘নিউক্লিয়ার ট্রায়াড’ বা পরমাণু ত্রিশূল আমেরিকা এবং রাশিয়ার রয়েছে বলেই এত দিন ধরা হত। এ বার ভারতও আনুষ্ঠানিক ভাবে ঘোষণা করল যে, পরমাণু ত্রিশূল গঠন সম্পন্ন।
আরও পড়ুন: ঠিকুজি-কুষ্ঠি বের করে ফেলেছি, ৪ দিনের মধ্যে টের পাবেন পুলিশ কর্মীরা, হুঁশিয়ারি মনোজের
পরমাণু ত্রিশূল থাকলে কী সুবিধা?
প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞরা বলেন, পরমাণু অস্ত্র হাতে থাকলেই পরমাণু হামলার জবাব দেওয়া যায়, এমন নয়। পরমাণু অস্ত্র ব্যবহার করার জন্য যে কোনও পরমাণু শক্তিধর দেশেই একটি করে ‘কম্যান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল সিস্টেম’ থাকে। কিন্তু কোনও দেশ পরমাণু হামলার শিকার হলে ধ্বংসলীলা এত সাঙ্ঘাতিক পর্যায়ে পৌঁছনোর আশঙ্কা থাকে যে, ‘কম্যান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল সিস্টেম’ ভেঙে পড়ার সম্ভাবনা প্রবল হয়। প্রথমে যারা পরমাণু হামলা চালাবে, তারা কম্যান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল সিস্টেমটা ভেঙে দেওয়ার লক্ষ্য নিয়েই চালাবে, এমনটাও ধরে নেওয়া হয়। সে ক্ষেত্রে পাল্টা পরমাণু হামলার সক্ষমতা হারিয়ে ফেলতে পারে আক্রান্ত দেশটি। তাই শুধুমাত্র দেশের মূল ভূখণ্ড বা স্থলভাগ থেকে পরমাণু হামলা চালানোর সক্ষমতায় সন্তুষ্ট হওয়া কাজের কথা নয় বলে প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞদের মত। আকাশ থেকে বা জলভাগ থেকেও পরমাণু হামলা চালানোর সক্ষমতা জরুরি বলে তাঁরা মনে করেন। আইএনএস অরিহন্তের সাফল্যে সেই সক্ষমতায় ভারত পৌঁছে গেল।
ভারতীয় নৌবাহিনীর হাতে রয়েছে ডুবোজাহাজ কালভারি। —ফাইল ছবি
অবসরপ্রাপ্ত সেনাকর্তা কর্নেল সৌমিত্র রায় বললেন, ‘‘ভারতে পরমাণু হামলা চালিয়ে যদি কোনও প্রতিপক্ষ দেশ কম্যান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল সিস্টেম ভেঙে দেয়, তা হলেই সে দেশটা নিরাপদ হয়ে গেল, এমনটা ভাবার কোনও কারণ নেই। আইএনএস অরিহন্ত হল এমন সাবমেরিন, যা সমুদ্রের তলা দিয়ে প্রতিপক্ষের ভূখণ্ডের খুব কাছে গিয়ে অপেক্ষা করতে পারে। মূল ভূখণ্ডে কম্যান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল সিস্টেম ভেঙে গেলেও সমুদ্রের তলা থেকে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে প্রতিপক্ষের ভূখণ্ডের গভীরে ভারতের অরিহন্ত আঘাত হানতে পারবে।’’
আরও পড়ুন: ‘শিল্প আনার হ্যাপা অনেক, গো-পালন ঢের ভাল’, ফের বেলাগাম বিপ্লব
আক্রান্ত হওয়ার পরে পাল্টা পরমাণু হামলা চালানোর এই সক্ষমতাকে ‘সেকেন্ড অ্যাটাক কেপেবিলিটি’ বলা হয়। আমেরিকা এবং রাশিয়ার সে সক্ষমতা ছিলই। চিন, ব্রিটেন, ফ্রান্সের হাতে পুরোদস্তুর পরমাণু ত্রিশূল থাক বা না থাক, ‘সেকেন্ড অ্যাটাক কেপেবিলিটি’ ছিল। ভারতও সফল ভাবে সেই সক্ষমতা অর্জন করল, সম্পূর্ণ করে ফেলল পরমাণু ত্রিশূল তৈরির কাজও।
কর্নেল সৌমিত্র রায়ের কথায়, ‘‘ডেটারেন্স পোট্রোল ট্রায়াল সম্পূর্ণ হওয়া খুব বড় বিষয়। এই মহড়ার অর্থ হল, দেশের জলসীমার মধ্যে এবং দেশের জলসীমার বাইরে অর্থাৎ আন্তর্জাতিক জলভাগেও হানা দিয়েছিল ভারতের এই নিউক্লিয়ার সাবমেরিন। সেখানে ভারতীয় বাহিনীরই অন্যান্য যুদ্ধজাহাজ বা সাবমেরিনও ছিল। মহড়ায় তারা প্রতিপক্ষ হিসেবে লড়াই করেছে এবং অরিহন্ত সফল ভাবে ক্ষেপণাস্ত্র বা অন্যান্য অস্ত্র প্রয়োগ করে সে যুদ্ধ জিতে নিয়েছে।’’
পরমাণু শক্তিচালিত ডুবোজাহাজগুলোর ইঞ্জিনের শব্দ অত্যন্ত কম। ফলে সমুদ্রের তলা দিয়ে খুব নীরবে হানা দিতে পারে এগুলি। প্রতিপক্ষের রাডারকে ফাঁকি দিতেও এই সাবমেরিনগুলি দক্ষ। তাই যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে প্রতিপক্ষের ভূখণ্ডের কাছাকাছি গিয়ে কোথায় ঘাপটি মেরে অপেক্ষা করে এই সব ডুবোজাহাজ, তা বোঝা খুব কঠিন। ডুবোজাহাজের মধ্যেই শক্তি উৎপাদনের ব্যবস্থা থাকে, ফলে জ্বালানি ভরার জন্য বন্দরে ফিরতে হয় না একে, মূল ভূখণ্ড থেকে বহু দূরে গিয়ে হামলা চালাতে পারে।
আইএনএস অরিহন্ত থেকে আপাতত দু’রকমের পরমাণু অস্ত্রবাহী ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়া যাবে। ‘সাগরিকা’ এবং ‘কে-৪’। সাগরিকা ৭৫০ কিলোমিটার দূরের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে পারে। আর কে-৪ হল অগ্নি ৩-এর সাবমেরিন লঞ্চড সংস্করণ। ৩৫০০ কিলোমিটার উড়ে গিয়ে পরমাণু হামলা চালাতে পারে এটি। ফলে চিন বা পাকিস্তানের অধিকাংশ গুরুত্বপূর্ণ শহরকেই নিশানা করা যাবে আইএনএস অরিহন্ত থেকে।
নিউক্লিয়ার সাবমেরিন ভারতের হাতে নতুন এল, এমন নয়। রাশিয়ার কাছ থেকে আগেই আকুলা ক্লাস নিউক্লিয়ার সাবমেরিন লিজ নিয়েছিল ভারত। আইএনএস চক্র নামে সেই পরমাণু শক্তিচালিত রুশ ডুবোজাহাজেই ভারতীয় নৌসেনার প্রশিক্ষণ হয়েছে। নিউক্লিয়ার সাবমেরিন কী ভাবে কাজ করে, কত দূর গিয়ে হামলা চালাতে পারে, কোন ধরনের অস্ত্র ব্যবহার করতে পারে বা নিউক্লিয়ার সাবমেরিনের রক্ষণাবেক্ষণ কী ভাবে করতে হয়, আইএনএস চক্র-ই তা শিখিয়েছে ভারতে। একই সঙ্গে চলছিল আইএনএস চক্রের চেয়েও শক্তিশালী এবং পারদর্শী নিউক্লিয়ার সাবমেরিন আইএনএস অরিহন্ত তৈরির কাজ। ২০০৯ সালে অরিহন্তকে আনুষ্ঠানিক ভাবে জলে নামানো হয়েছিল। নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরে ২০১৪ সালে সাবমেরিনটির সি ট্রায়াল শুরু হয়। ২০১৬ সালে সাবমেরিনটি আনুষ্ঠানিক ভাবে নৌসেনায় কমিশনড হয়। ২০১৮-র ৫ নভেম্বর ভারতের প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করলেন, অরিহন্তের প্রথম ডেটারেন্স পেট্রোল মহড়া সফল, ভারতের পরমাণূ ত্রিশূল সম্পূর্ণ ভাবে প্রস্তুত।
ভারতের রাজনীতি, ভারতের অর্থনীতি- সব গুরুত্বপূর্ণ খবর জানতে আমাদের দেশ বিভাগে ক্লিক করুন।