প্রতীকী ছবি।
খুচরোর মতো পাইকারি বাজারের মূল্যবৃদ্ধিও সামান্য মাথা নামাল বটে। কিন্তু বাস্তবে দামের কামড় কমার তেমন লক্ষণ দেখা গেল না দেশে। বরং বৃহস্পতিবার কেন্দ্র জুনের হিসাব প্রকাশের পরে উদ্বেগ বাড়ল টানা তিন মাস ধরে পাইকারি মূল্যবৃদ্ধির হার ১৫ শতাংশের উপরে থাকায়। তা দাঁড়িয়েছে ১৫.১৮%। ১৫ মাস ধরে ১০ শতাংশের বেশি। খাদ্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি ১৪% ছাড়িয়েছে। শুধু আনাজেরই প্রায় ৫৭%। বুধবার জানা গিয়েছিল, খুচরো মূল্যবৃদ্ধির হার এখনও ৭ শতাংশের উপরে। এমনকি সেখানেও আনাজের মূল্যবৃদ্ধির হার অত্যন্ত চড়া, ১৭.৩৭%।
তার উপরে ঐতিহাসিক তলানিতে টাকার দাম। বৃহস্পতিবার এক ডলার প্রায় ১৮ পয়সা বেড়ে ৮০ টাকা ছুঁইছুঁই হয়েছে (৭৯.৯৯)। ফলে বিশ্ব বাজারে বহু দিন পরে অশোধিত তেলের দর ব্যারেল পিছু প্রায় ৯৭ ডলারে নামলেও, ভারতে পেট্রল-ডিজ়েলের দাম কমবে না বলেই ধারণা। কারণ, আগুন ডলারে দেশে আমদানির খরচ বাড়ছে। যা বাণিজ্য ঘাটতিকে ইতিমধ্যেই রেকর্ড উচ্চতায় ঠেলে তুলেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, সব মিলিয়ে অর্থনীতি ঘিরে উদ্বেগের নিকষ কালো মেঘ। সুদিন ফেরার কোনও চিহ্ন নেই। টাকা এবং মূল্যবৃদ্ধিকে হাতিয়ার করে এ দিন মোদী সরকারকে ফের তুলোধোনা করেছেন বিরোধীরা।
ইউপিএ জমানায় টাকার দামের পতন নিয়ে বিরোধী বিজেপি প্রায়ই প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহকে বিঁধে বলত, ডলার নাকি তাঁর বয়সকে ছাড়িয়ে যাবে। কার্যত তারই পাল্টা হিসেবে এ দিন মোদী সরকারকে দুষেছে কংগ্রেস। ৮০ টাকা দামের ডলারকে অমৃতকাল তকমা দিয়ে টুইটে কটাক্ষ ছুড়েছেন রাহুল গান্ধী। দলের সেক্রেটারি জেনারেল রণদীপ সূরজেওয়ালার দাবি, ‘‘এখন টাকার দাম ‘মার্গদর্শক মণ্ডল’-এর বয়স পেরিয়ে গিয়েছে। তা আর কত পড়বে?’’ উল্লেখ্য, মার্গদর্শক মণ্ডল বিজেপির পুরনো এবং অভিজ্ঞ সদস্যদের নিয়ে তৈরি গোষ্ঠী। বেকারত্ব এবং খাদ্যপণ্যের চড়া মূল্যবৃদ্ধির হিসাব তুলে ধরে সিপিএমের সীতারাম ইয়েচুরির তোপ, এই সরকার জীবনযাপন এবং ভবিষ্যৎ ধ্বংস করার দায় নেবে কি?
অর্থনীতিবিদ অভিরূপ সরকারের দাবি, খুচরো বাজারে মূল্যবৃদ্ধির হার মাথা তুললে সরাসরি আমজনতা ক্ষতিগ্রস্ত হন। কারণ, সেখানে পকেট থেকে বেশি টাকা বার করতে হয় তাঁদের। সেটা হয়তো পাইকারি বাজারের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। কিন্তু লাগাতার চড়া পাইকারি মূল্যবৃদ্ধির ধাক্কা একটা সময় পরে সাধারণ ক্রেতার বাজেটেই ধাক্কা দেয়। অভিরূপবাবুর কথায়, ‘‘পাইকারি দাম চড়ে থাকলে সব থেকে আগে ধাক্কা খান পণ্য উৎপাদনকারী। যাঁরা ওই বাজারের ক্রেতা। সেই বাড়তি খরচ তাঁরা ঠেলে দেন পণ্যের দামে। যা খুচরো বাজারে গিয়ে ক্রেতার ঘাড়ে চাপে। ডিস্ট্রিবিউটরেরা যখন পাইকারি পণ্য কিনে খুচরো বিক্রেতাকে জোগান দেন, তখনও এই শৃঙ্খল কাজ করে।’’
সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, পাইকারি মূল্যবৃদ্ধি এতটা চড়া থাকার প্রধান কারণ আনাজ, আলু, ফলের মতো খাদ্যপণ্যের মাত্রাছাড়া দাম। সেই সঙ্গে অশোধিত তেল এবং প্রাকৃতিক গ্যাস খাতে ৭৭.২৯%, জ্বালানি এবং বিদ্যুতে ৪০.৩৮% মূল্যবৃদ্ধির ধাক্কাও রয়েছে। তবে এ দিন অর্থনীতি নিয়ে কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রকের মাসিক রিপোর্টে বলা হয়েছে, বিশ্ব জুড়ে মন্দার আশঙ্কায় সেখানে জিনিসপত্রের দাম কমার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে চাহিদা কমার কারণে। এটা ভারতের পক্ষে শাপে বর হতে পারে। যদিও সামগ্রিক ভাবে আর্থিক বৃদ্ধি ধাক্কা খাওয়ার ঝুঁকি বাড়ছে বলে মেনে নিয়েছে তারা। কারণ তাতে রফতানি বাণিজ্য ধাক্কা খাবে। সে ক্ষেত্রে আমদানি খরচ বাড়ার দরুন এই অর্থবর্ষে চলতি খাতে বিদেশি মুদ্রা লেনদেন ঘাটতি বাড়তে পারে বলেও আশঙ্কা কেন্দ্রের।
পরিসংখ্যান বলছে, জুনে দেশের বাণিজ্য ঘাটতি নজিরবিহীন ভাবে ২৬১৮ কোটি ডলার ছুঁয়েছে। এক বছর আগে ছিল ৯৬০ কোটি। কারণ, রফতানি ২৩.৫২% বেড়েছে ঠিকই। তবে তার থেকে অনেক বেশি বেড়েছে আমদানির অঙ্ক, ৫৭.৫৫%। আর্থিক বিশেষজ্ঞ অনির্বাণ দত্ত বলেন, লাগাতার ডলারের দাম বৃদ্ধির অন্যতম কারণ বাড়তে থাকা আমদানির বহর। এত বেশি ডলার খরচ হচ্ছে বলে তার চাহিদা ও দাম বেড়েছে। আগে আশঙ্কা ছিল তার দাম ৮০ টাকার আশেপাশে থাকবে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে টাকা আরও পড়তে পারে। তিনি বলেন, “মোদী সরকার আত্মনির্ভর ভারতের কথা বড় গলায় বললেও ভারত ক্রমশ আরও বেশি আমদানি নির্ভর হয়ে উঠছে। এমনটা চললে দেশের বিদেশি মুদ্রার ভান্ডার দুর্বল হবে। ইতিমধ্যেই তাতে হাত দিতে হয়েছে।’’
পটনা আইআইটি-র অর্থনীতির অধ্যাপক রাজেন্দ্র পরামানিকের মতে, টাকার দাম কমার অর্থ বাজারে মুদ্রার জোগান বেশি। আর মুদ্রার জোগান বেশি থাকলে তা মূল্যবৃদ্ধিকে রসদ জোগাবেই। দুশ্চিন্তা প্রকাশ করে নিপা এক্সপোর্টসের ডিরেক্টর রাকেশ শাহ বলছেন, “মূল্যবৃদ্ধির কারণে সারা বিশ্বে চাহিদা কমছে। এটা মন্দার লক্ষণ। ফলে কমতে শুরু করেছে ভারতের রফতানি বাণিজ্য। কতটা কমবে সেটাই প্রশ্ন।’’ রাকেশের মতো অনেকেরই দাবি, ভারতে যে চাহিদা রয়েছে সেটাও দেশে তৈরি পণ্য দিয়ে মেটানো যাচ্ছে না। জোগানের ওই ঘাটতি মেটাতেও বাড়াতে হচ্ছে আমদানি। যা ডলারের দাম বৃদ্ধিতে রসদ জোগাচ্ছে।
বিশ্ব জুড়ে মন্দার ভয়েই দাম কমতে শুরু করেছে অশোধিত তেলের। কারণ, আমেরিকায় মূল্যবৃদ্ধি ৯% ছাড়ানোর পরে সকলে মোটামুটি নিশ্চিত সেখানে সুদ আরও বাড়বে। একই পথে হাঁটতে পারে অন্যান্য দেশ। তার উপরে করোনা সংক্রমণ বাড়ায় চিনে ফের বিধিনিষেধের কড়াকড়ি চলছে। সব মিলিয়ে মুখ থুবড়ে পড়তে পারে চাহিদা। যার মাসুল গুনবে আর্থিক বৃদ্ধিই। সে ক্ষেত্রে মন্দা ঘনিয়ে আসতে পারে বলেও আশঙ্কা। এই পরিস্থিতিতে চাহিদা কমার আশঙ্কাতেই ব্রেন্ট ক্রুডের দাম নামতে শুরু করেছে। বৃহস্পতিবার তা এক সময় ৯৪ ডলারে নেমে আসার খবর অন্তত ভারতের মতো তেলের আমদানি নির্ভর দেশের জন্য বিরাট স্বস্তির। পরে অবশ্য কিছুটা উঠে প্রায় ৯৭ ডলার হয়। তবে মধ্যরাত পর্যন্ত ১০০ পেরোয়নি। কেন্দ্র বহু দিন ধরেই বলছে, বিশ্ব বাজার থেকে চড়া দামে কিনতে হচ্ছে বলেই দেশে জ্বালানির দাম বাড়াতে বাধ্য হচ্ছে রাষ্ট্রায়ত্ত তেল সংস্থাগুলি। কিন্তু এখন বিশ্ব বাজারের দাম কমলেও সংশ্লিষ্ট সূত্রের দাবি, আমজনতার ঘরে সেই লাভ পৌঁছনোর রাস্তা বন্ধ। আগুন ডলারে আমদানির খরচ চড়াই। ফলে মাঠে মারা যাচ্ছে দেশে পেট্রল-ড়িজ়েল ও রান্নার গ্যাসের দাম কমার আশা।