চিনের সিল্ক রুটের টক্কর নেবে ভারতের কটন রুট!
ভারত মহাসাগরের একটা বড় অংশে চিন তাদের প্রভাব বাড়িয়ে চলেছে। তাদের নৌবহরের আনাগোনা বাড়ছে এই এলাকায়। এর মোকাবিলায় প্রাচীন ‘কটন রুট’-এর ঐতিহ্য ফেরাতে চাইছে নরেন্দ্র মোদীর সরকার। চাইছে ভারত মহাসাগরের দেশগুলির সঙ্গে বাণিজ্যিক ও সামরিক সম্পর্ক নতুন করে ঝালিয়ে নিতে।
তারই প্রথম ধাপ হিসেবে বছরের প্রথম বিদেশযাত্রায় বেরিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। সেসেলস সফর সেরে তিনি আজ মরিশাসে পৌঁছেছেন। এর পরে যাবেন শ্রীলঙ্কা। ভারতের কোনও প্রধানমন্ত্রী সেসেলসে গেলেন ৩৪ বছর পর। সে দেশের প্রেসিডেন্ট জেমস অ্যালেক্সিস মাইকেলের সঙ্গে বৈঠকে ভারত মহাসাগরীয় দেশগুলির সহযোগিতার উপরে বিশেষ জোর দেন মোদী। মরিশাসে সে দেশের প্রধানমন্ত্রী অনিরুদ্ধ জগন্নাথ ও শ্রীলঙ্কায় প্রেসিডেন্ট মৈত্রীপালা সিরিসেনার সঙ্গে বৈঠকেও মূলত একই বার্তা দেবেন তিনি।
সফর শুরুর আগেই মোদী ঘোষণা করে গিয়েছেন, ভারত মহাসাগরের বন্ধু দেশগুলিকে দরকারে সামরিক সাহায্য করতে ভারত প্রস্তুত। সেই ঘোষণা মতোই সেসলসের সঙ্গে প্রতিরক্ষা সহযোগিতার চারটি চুক্তি হয়েছে মোদীর সফরে।
প্রধানমন্ত্রী দেশে ফেরার পরই আগামী ২০-২২ মার্চ ভুবনেশ্বরে ‘ভারত ও ভারত মহাসাগর’ শীর্ষক একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন হবে। বিদেশ মন্ত্রকের উদ্যোগে এর আয়োজন করা হলেও সহযোগী হিসেবে থাকবে আরও অন্তত ৮টি মন্ত্রক। ইন্ডিয়ান ওশেন রিম অ্যাসোসিয়েসন (আইওআরএ)-এর সদস্য সব ক’টি দেশের প্রতিনিধিদের ডাকা হচ্ছে এই সম্মেলনে। উদ্বোধন করবেন বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ। সমাপ্তি অনুষ্ঠানে থাকার কথা প্রতিরক্ষা মন্ত্রী মনোহর পর্রীকর ও বিদেশসচিব এস জয়শঙ্করের। নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল থাকবেন আগাগোড়াই। পেট্রোলিয়াম, বাণিজ্য ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী-সহ অন্তত আধ ডজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী এই সম্মেলনে যোগ দেবেন বলে বিদেশ মন্ত্রক সূত্রে জানা গিয়েছে।
মোদীর সফর ও তার পরপরই এই সম্মেলন ভারত মহাসাগরের দেশগুলিকে নিয়ে দিল্লির এই তৎপরতার কারণ কী?
বিদেশ মন্ত্রকের এক অফিসার জানাচ্ছেন, নামেই প্রমাণ, ঐতিহাসিক ভাবেই ভারত মহাসাগর আসলে ভারতের মহাসাগর। কিন্তু গত দু’দশকে ভারত মহাসাগরের বিভিন্ন দেশে চিন যে ভাবে প্রভাব বাড়িয়েছে তা যথেষ্ট উদ্বেগের। শ্রীলঙ্কার দক্ষিণ ভাগে চিনের ডুবোজাহাজের উপস্থিতিও নজরে এসেছে নৌবাহিনীর। শ্রীলঙ্কার হানবোনটোটা, বাংলাদেশের চট্টগ্রাম, পাকিস্তানের গদরে বন্দর নির্মাণের কাজে চিনা সংস্থা বিনিয়োগ করছে। ভারতীয় নিরাপত্তা সংস্থাগুলির আশঙ্কা, চিন শুধুমাত্র বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যেই এই সব বন্দর নির্মাণে লগ্নি করছে না, এর পিছনে রয়েছে সামরিক লক্ষ্যও। এই পরিস্থিতিতে ভারত মহাসাগরের দেশগুলির সঙ্গে এ দেশের বহু প্রাচীন বাণিজ্যিক যোগাযোগ এবং বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ঝালিয়ে নেওয়াটা খুবই জরুরি হয়ে উঠেছে বলে মনে করছে দিল্লি।
বিদেশ মন্ত্রকের ওই কর্তার কথায়, “মধ্য ও পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে চিনের স্থলবাণিজের যোগসূত্র হল সিল্ক রুট। ভারতের সঙ্গেও নৌবাণিজ্যের মাধ্যমে পূর্ব এশিয়া তথা প্রাচ্যের বাকি দেশগুলির সঙ্গে যোগাযোগ ছিল প্রাচীন কাল থেকেই। অন্য বিভিন্ন সামগ্রীর সঙ্গে ভারতের তুলো তথা সূতিবস্ত্র নৌপথে যেত এই সব দেশে। ভারত মহাসাগরে নিজেদের প্রভাব বাড়াতে নৌবাণিজ্যের সেই ‘কটন রুট’-কেই ফের জোরদার ভাবে ব্যবহার করতে চাইছে ভারত।”
ভারত মহাসাগরের দেশগুলির সঙ্গে নতুন উদ্যমে বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক বাড়ানোর কাজ শুরু হবে। সেই লক্ষ্যেই ভুবনেশ্বরের সম্মেলনে বিদেশমন্ত্রী সুষমা চিনের সিল্ক রুটের পাল্টা কটন রুটের ইতিহাসকে নতুন করে সামনে আনবেন বলে জানা গিয়েছে।
শুধু বাণিজ্য বা সাংস্কৃতিক যোগাযোগ নয়, ভারত মহাসাগরীয় এলাকায় দেশের সামরিক উপস্থিতি ও সক্রিয়তা বাড়ানোরও পরিকল্পনা করছেন প্রধানমন্ত্রী মোদী। বিদেশ মন্ত্রকের এক কর্তা জানাচ্ছেন, এখনও মালাক্কা খাঁড়ি দিয়ে বিশ্বের প্রয়োজনীয় জ্বালানির অর্ধেক এবং চিনের ৯০%-এর বেশি তেল আনানেওয়া হয়। সেই মালাক্কা খাঁড়িতে ভারতীয় নৌবাহিনীর উপস্থিতি ও প্রভাব আরও জোরদার করতে চায় ভারত। সেই বার্তাও ওই সম্মেলনে তুলে ধরা হবে। জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী জানাবেন, ভারত মহাসাগরের দেশগুলির জ্বালানি ও অন্যান্য পণ্য পরিবহণের ক্ষেত্রে নিরাপত্তা দিতে নয়াদিল্লি আরও সদর্থক ভূমিকা নেবে।
আন্তর্জাতিক এই সম্মেলনের মূল আয়োজক হল বিদেশ মন্ত্রকের অধীনে থাকা সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেম ফর ডেভেলপিং কান্ট্রিজ এবং কলকাতার একটি ‘থিঙ্ক-ট্যাঙ্ক’ ইনস্টিটিউট অব সোশ্যাল অ্যান্ড কালচারাল স্টাডিজ (আইএসসিএস)। আইএসসিএসের কর্তা অরিন্দম মুখোপাধ্যায়ের কথায়, “হাজার বছর আগে দক্ষিণের চোল বংশের রাজা রাজেন্দ্র চোলের আমলে নৌবাণিজ্যে ভারত এতটাই শক্তিশালী ছিল যে, সে সময় ভারত মহাসাগরকে চোল হ্রদ বলা হতো। আর এখন ভারত মহাসাগরে উত্তরোত্তর চিনের প্রভাব বাড়ছে।” এই পরিস্থিতিতে ভারত মহাসাগরকে ফের ভারতের মহাসাগর করে তোলারই প্রয়াস শুরু হবে ভুবনেশ্বরের সম্মলনে, জানালেন অরিন্দমবাবু।
যদিও এক নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ জানাচ্ছেন, চিনের সিয়ান প্রদেশ থেকে ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত চার হাজার বছরের পুরনো সিল্ক রুট ধরে চিনা আধিপত্য বিস্তারে অনেকটাই এগিয়ে গিয়েছে বেজিং। দক্ষিণ চিন সাগরে অন্যান্য দেশের যাবতীয় কার্যকলাপ নস্যাৎ করে দিয়েছে তারা। এমনকী, ভিয়েতনামে তেল সন্ধানের কাজ বাতিল করতে হয়েছে ভারতকে। চিনের নিশানায় এখন ভারত মহাসাগর। শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ, মায়ানমার, বাংলাদেশেও চিনের জাহাজের সংখ্যা হালে অনেকটাই বেড়েছে। ভারত মহাসাগরের আর্ন্তজাতিক জলসীমায় প্রায়ই চিনের নৌবহর এসে ঘাঁটি গাড়ছে। তাদের ডুবোজাহাজের উপস্থিতিও মালুম হয়েছে ভারতীয় নৌ বাহিনীর। ভারত মহাসাগরে প্রাচীন কর্তৃত্ব ফিরে পাওয়াটা তাই সহজ নয়।
তবু দেরিতে হলেও ভারত সরকারের ঘুম যে ভেঙেছে, এটাই আশার কথা বলে মনে করছেন ওই নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ।