গুরমিত রাম রহিম। ফাইল চিত্র।
গত তিন দিনের নাটকের পর্দা পড়বে এখানেই।
দিগন্ত ছোঁয়া আখখেতের মাঝে কালো ফিতের মতো রাস্তাটা পৌঁছেছে সুনারিয়া জেলা সংশোধনাগারে। আর তার আটশো মিটার আগে পাণ্ডববর্জিত এবং ওবি ভ্যানখচিত এই খেত-রাস্তার মোড়টির পরে আর যেতে পারছে না সংবাদমাধ্যম। সামনে লোহার রেলিং দিয়ে গড়া ব্যারিকেড।
এখানেই অপেক্ষমান মিডিয়ার অস্থায়ী তাঁবুতে কাঁটায় কাঁটায় তিনটে পঁচিশ মিনিটে এসে পৌঁছলো খবরটা। ডেরা সচ্চা সৌদার প্রধান, গুরমিত রাম রহিম সিংহকে দু’টি ধর্ষণের প্রত্যেকটির জন্য দশ বছর করে অর্থাৎ মোট কুড়ি বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন সিবিআই বিশেষ আদালতের বিচারক জগদীপ সিংহ। ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩৭৬ ধারা (ধর্ষণ) এবং ৫০৬ ধারা (হুমকি দেওয়া) অনুযায়ী এই শাস্তি দেওয়া হয়েছে।
সুনারিয়া জেল চত্বরেই বসা বিশেষ সিবিআই আদালত সূত্রের খবর, দু’পক্ষের আইনজীবীকে এ দিন দশ মিনিট করে বলার সুযোগ দিয়েছিলেন বিচারক। তার পর তিনি নিজের রায় শুনিয়েছেন। কারাদণ্ডের পাশাপাশি রাম রহিমকে মোট ৩০ লাখ ২০ হাজার টাকা জরিমানা দিতে হবে। তার মধ্যে দুই নির্যাতিতা প্রত্যেকে ১৪ লক্ষ টাকা করে পাবেন। রাম রহিমের আইনজীবী এস কে নর্বানা জানিয়েছেন, এই রায়কে চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে আবেদন করা হবে। সূত্রের খবর, দুই নির্যাতিতা পাল্টা জানিয়েছেন, রাম রহিমের আরও কঠোর শাস্তি চেয়ে তাঁরাও উচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হবেন।
আরও পড়ুন: আমি গডম্যান, বাঁচাও আমাকে
আজ আদালতে ডেরা প্রধানের সমাজসেবামূলক কাজের খতিয়ান দিয়ে তার শাস্তির মেয়াদ কমানোর জন্য আবেদন করেন রাম রহিমের আইনজীবী নর্বানা। অন্য দিকে সিবিআই পক্ষের আইনজীবী রাম রহিমের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দাবি করেন। ‘রকস্টার’ এই গুরুর বিরুদ্ধে প্রমাণিত অপরাধে ন্যূনতম সাজার মেয়াদ ৭ বছর। এ ক্ষেত্রে ন্যূনতম শাস্তির থেকে বেশি দেওয়া হয়েছে, কিন্তু সর্বোচ্চ অর্থাৎ যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়নি আদালত। ৯ পাতার রায়ের ছত্রে ছত্রে গুরমিতকে তুলোধনা করেছেন বিচারক। মহিলা অনুগামীদের প্রতি তাঁর আচরণের তীব্র নিন্দা করে বিচারক জগদীপ সিংহ বলেছেন, ধর্মপ্রাণ ভক্তদের সঙ্গে বন্য জন্তুর মতো আচরণ করেছেন ওই ধর্মগুরু। কোনও মার্জনাই তিনি আশা করতে পারেন না।
এই নাটকীয় মামলার রায় শোনাতে আজ যে ভাবে এলেন বিচারক, সেটিও কম নাটকীয় নয়। ‘গ্রাউন্ড জিরো’-তে বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই আকাশে চোখ গেঁথে বসেছিলেন সাংবাদিকেরা। কারণ ওই চত্বরে সাংবাদিক আর নিরাপত্তাবাহিনী ছাড়া অন্য কারও প্রবেশ ছিল নিষিদ্ধ। বেলা দু’টো নাগাদ কপ্টারে চেপে সংশোধনাগার চত্বরে নামলেন বিচারক। আর তার পর দ্রুতই শেষ হল শুনানি এবং রায়দান।
হতাশ: সাজা ঘোষণার পরে গুরমিতের আইনজীবী এস কে নর্বানা। হরিয়ানায়। রয়টার্স
এই রায়কে কেন্দ্র করে আজ সকাল থেকে টানটান উত্তেজনায় থমথমে হয়ে ছিল গোটা রোহতক। ক’দিন আগেই রাম রহিমকে দোষী সাব্যস্ত করার দিন দাউদাউ আগুন দেখেছিল রোহতক। আজ যেন শ্মশানের স্তব্ধতা। রাস্তায় লোক কম, গাড়ি আরও কম। কার্নাল ছাড়িয়ে রোহতকে পৌঁছনোর পর থেকে দফায় দফায় চেকপোস্ট। বালির বস্তা দিয়ে তৈরি পাঁচিলেও ওপারে সামরিক বাহিনীর উদ্যত রাইফেল। এবং বন্ধ নেট-সংযোগ! পরিচয়পত্র দেখিয়ে সাংবাদিক বলার পরেও প্রায় চার বার গাড়ি থামিয়ে তল্লাশি হল। রায় ঘোষণার আগেই সিরসায় দু’টি বাসে আগুন লাগানোর খবর পৌঁছনোর সঙ্গে সঙ্গে রোহতকেও বেড়ে গেল টেনশন। নির্দেশ এল, শুধু মাত্র ওষুধের দোকান ছাড়া বন্ধ করে দিতে হবে অন্য সব দোকান। শুধু শহর নয়, রোহতককে কেন্দ্র করে আশপাশের গ্রামগুলিতেও যাতে কোনও সচ্চা-ভক্ত লুকিয়ে থাকতে না পারে, সে জন্য আজ চিরুনি তল্লাশি চালিয়েছে হরিয়ানা পুলিশ এবং
আধা সামরিক বাহিনী। স্থানীয় মানুষদের বক্তব্য, জাঠ সংরক্ষণ নিয়ে গত বছর বিক্ষোভের সময়টুকু ছাড়া সাম্প্রতিক অতীতে এমন সেনা-বন্দি হরিয়ানা দেখেননি তাঁরা।
দিনের শেষে অবশ্য স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছেন রোহতকবাসী।