প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ছবি: সংগৃহীত।
রান তাড়া করে ম্যাচ জিততে হলে মহেন্দ্র সিংহ ধোনি প্রথমেই ব্যাট হাতে ঝড় তুলতেন না। ধীরে-সুস্থে রান তুলে শেষ ওভারে গিয়ে ম্যাচ জয়ের ছক্কা হাঁকাতেন।
লোকসভা ভোটের আগের বছরে যে কোনও সরকারই জনমোহিনী বাজেট করে। আজ নরেন্দ্র মোদীও ধোনির মতো সে পথে না হেঁটে আপাতত আর্থিক বৃদ্ধিতে জোর দিলেন। শেষ ওভারে জয়ের জন্য জরুরি রান যথাসম্ভব কমিয়ে রাখা দরকার ছিল। তার জন্য লোকসভা ভোটের এক বছর আগের বাজেটে মধ্যবিত্তদের জন্য কর ছাড়ের ঘোষণা হল, যদিও তাতে মধ্যবিত্তের কতটা সুরাহা হবে তা নিয়ে প্রশ্ন ঝুলে রইল। এ ছাড়া বাজেটে আর তেমন কোনও উপহারের দেখা মিলল না। উল্টো দিকে একশো দিনের কাজ, পিএম-পোষণের মতো সামাজিক ক্ষেত্র থেকে শুরু করে খাদ্য, সার ভর্তুকিতে খরচে বিপুল পরিমাণে খরচ ছাঁটাই করা হল বাজেটে। মূল্যবৃদ্ধির মাথাব্যথা নিয়েও বাজেটে একটি শব্দ খরচ করা হল না।
মোদী সরকারের হাবভাব দেখে রাজনীতিকদের ধারণা, ধোনির মতোই মোদী লোকসভা ভোটের আগে শেষবেলায় ছক্কা হাঁকানোর মতো কিছু ঘোষণা আস্তিনে লুকিয়ে রাখলেন। প্রয়োজন মতো বছরের শেষে হিন্দি বলয়ের তিন রাজ্য, রাজস্থান-মধ্যপ্রদেশ-ছত্তীসগঢ়ের ভোটের আগে সে ঘোষণা হতে পারে। বা আগামী বছর লোকসভা ভোটের
ঠিক আগে অন্তর্বর্তী বাজেটে তার ঘোষণা হতে পারে। ঠিক যেমন ২০১৯-এর লোকসভা ভোটের আগে নরেন্দ্র মোদী পিএম-কিসান প্রকল্প ঘোষণা করে চাষিদের বছরে ৬ হাজার টাকা করে দেওয়ার ঘোষণা করেছিলেন।
জনমোহিনী বাজেটের বদলে বুধবার অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন তাঁর বাজেটে প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন, কোভিড, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ঝোড়ো হাওয়া কাটিয়ে অর্থনীতিতে ‘অচ্ছে দিন’ ফিরে এসেছে। অর্থনীতির গতি বাড়াতে তিনি পরিকাঠামো-সহ মূলধনী খাতে খরচ বাড়ানোর পথে হেঁটেছেন। এই প্রথম পরিকাঠামো-সহ মূলধনী খাতে ১০ লক্ষ কোটি টাকার বেশি খরচ করতে চলেছে সরকার। চলতি বছরের খরচের তুলনায় প্রায় ৩৭% বেশি। ভোটের বদলে আর্থিক বৃদ্ধিতে নজর দেওয়া নিয়ে অর্থমন্ত্রীর মন্তব্য, ‘‘রাজনীতিক হলে ভোটের কথা মাথায় থাকবেই। কিন্তু বাজেটে আর্থিক বৃদ্ধিতে জোর দেওয়া হয়েছে।’’
বিরোধীদের ‘বেকারত্ব’ ইনস্যুইংয়ে উইকেট না চলে যায়, তার ব্যবস্থা পরিকাঠামোয় খরচেই রয়েছে বলে সম্ভবত মনে করছেন অর্থমন্ত্রী। কারণ, পরিকাঠামো তৈরি হলেই কাজের সুযোগ তৈরি হবে। বেসরকারি লগ্নির পথ খুলবে। তরুণদের ‘অমৃত প্রজন্ম’ বলে সম্বোধন করে তাঁদের চাকরি ও ব্যবসার সুযোগ তৈরি, প্রধানমন্ত্রী কৌশল বিকাশ যোজনার নতুন পর্বে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, রোবোটিক্স, থ্রি-ডি প্রিন্টিংয়ের মতো নতুন ক্ষেত্রে বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের কথা বলেছেন। পর্যটন, ছোট-মাঝারি শিল্পকে চাঙ্গা করেছেন।
শেষ ওভারে জয়ের জন্য জরুরি রান তুলে নেওয়ার হিসেব সব সময় ধোনি মেলাতে পারতেন না। অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামনের ক্ষেত্রেও একই সংশয় থেকে যাচ্ছে। বিশেষত আর্থিক বৃদ্ধি ও মূল্যবৃদ্ধির হার নিয়ে বাজেটের হিসেব মিলবে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বেকারত্বের সঙ্গেই মোদী সরকারের বিরুদ্ধে বিরোধীদের প্রধান অস্ত্র মূল্যবৃদ্ধি। চলতি অর্থ বছরে খুচরো মূল্যবৃদ্ধির হার ৬.৮%। আর্থিক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, বাস্তব বৃদ্ধির হার ৬.৫%। বাজেটে ধরে নেওয়া হয়েছে, আগামী অর্থ বছরে মূল্যবৃদ্ধি-সহ আর্থিক বৃদ্ধির হার ১০.৫% হবে। যার অর্থ, অর্থমন্ত্রী ধরে নিচ্ছেন, মূল্যবৃদ্ধি ৪ শতাংশের ঘরে থাকবে। তার ভিত্তিতেই তিনি খাদ্য, সার, পেট্রোপণ্যে প্রায় ১.৪৭ লক্ষ কোটি টাকা ভর্তুকি কমিয়েছেন।
অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, চিনের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ালে বিশ্ব বাজারে জিনিসপত্রের দাম ফের বাড়বে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ-পরিস্থিতি কোন দিকে যাবে, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে সমস্যা তৈরি হতে পারে। তার সঙ্গে অশোধিত তেলের দাম ফের বাড়লে দেশে মূল্যবৃদ্ধির ঢেউ এসে ধাক্কা মারবে। তখন সরকারকে আরও ভর্তুকি দিতে হতে পারে। অর্থমন্ত্রী আশা করছেন, আগামী অর্থ বছরে দেশের বাজারে চাহিদা বাড়বে। শিল্পমহলও নতুন পুঁজিতে খরচ করবে। তার ভিত্তিতেই তিনি আগামী বছর জিডিপি-র ১০.৫% বৃদ্ধি দেখা যাবে বলে মনে করছেন। যেমন চলতি অর্থ বছরেও টাকার অঙ্কে জিডিপি আশাতীত হারে বেড়েছে। জিডিপি আশাতীত ভাবে বেড়েছে বলেই অর্থমন্ত্রী তার তুলনায় এই অর্থ বছরে রাজকোষ ঘাটতি ৬.৪%-এ বেঁধে রাখার লক্ষ্য ছুঁতে পেরেছেন। সেইসঙ্গে আগামী বছর ঘাটতি ৫.৯%-এ কমিয়ে আনার লক্ষ্য নিয়েছেন। অর্থনীতির ‘অচ্ছে দিন’ ফেরার স্বপ্ন পূরণ না হলে বাজেটের ঘাটতির হিসেবও গুলিয়ে যেতে পারে।
একই ভাবে অর্থনীতিতে ‘অচ্ছে দিন’ ফিরে এসেছে যুক্তি দিয়েই তিনি একশো দিনের কাজে বরাদ্দ কমিয়েছেন। কারণ, লকডাউনের সময় গ্রামে ফেরা পরিযায়ী শ্রমিকরা ফের শহরে ফিরেছেন। সামাজিক প্রকল্পে খরচও কমানো সম্ভব হচ্ছে। বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, জিডিপি-র তুলনায় সামাজিক ক্ষেত্রে খরচ কমতে কমতে দু’দশক আগের পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে।
অর্থমন্ত্রীর যুক্তি, মূল্যবৃদ্ধিতে রাশ টানতে কেন্দ্রীয় সরকার আলাদা ভাবে ব্যবস্থা নিচ্ছে। যেমন, খোলা বাজারে গম ছাড়া হচ্ছে। কিন্তু মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে ক্ষোভকে ধামাচাপা দিতেই অর্থমন্ত্রী বাজেটে মধ্যবিত্তকে সুরাহা দিতে আয়করে ছাড়ের ঘোষণা করেছেন। কিন্তু তাতে মধ্যবিত্তের কতখানি লাভ হবে, তা হিসেব-সাপেক্ষ। কারণ, ‘অশ্বত্থামা হত, ইতি গজ’-র মতো অর্থমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন, নতুন কর ব্যবস্থায় গেলেই এই সুবিধা মিলবে। যে কর ব্যবস্থায় জীবন বিমা, পিপিএফ, বাড়ির ঋণে কোনও কর ছাড় মেলে না। আয়কর থেকে চলতি অর্থ বছরে সরকারের ঘরে ৮ লক্ষ কোটি টাকার বেশি আয় হচ্ছে। আগামী অর্থ বছরে ৯ লক্ষ কোটি টাকার আয় হবে। সেই তুলনায় আয়করে ছাড় দিতে মোদী সরকার মাত্র ৩৫ হাজার কোটি টাকার লোকসানের দায় নিচ্ছে। বিরোধীরা বলছেন, প্রধানমন্ত্রীর বন্ধু ধনী শিল্পপতিদের বেশি লাভ হবে। তাঁদের জন্য আয়করে সর্বোচ্চ সারচার্জ ৩৭% থেকে কমিয়ে ২৫% করে সর্বোচ্চ আয়করের হার ৪২.৭৪% থেকে কমিয়ে ৩৯% করেছেন। কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী বলেন, কর্মসংস্থান তৈরি, মূল্যবৃদ্ধির মোকাবিলা, ধনী-গরিব অসাম্য কমানোর কোনও রূপরেখা এই বাজেটে নেই। তাঁর মতে, এটা ‘অমৃত কাল’ নয়, ‘মিত্র কাল’-এর বাজেট।