চিনের পর আমেরিকাও এ বার কাশ্মীর প্রশ্নে ভারতের অস্বস্তি বাড়িয়ে তুলল।
পাক অধিকৃত কাশ্মীরে একটি জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য অর্থ সংগ্রহে ওবামা প্রশাসন সম্প্রতি ওয়াশিংটনে এক বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল। আমেরিকায় নিযুক্ত পাক রাষ্ট্রদূত, পাকিস্তানের অর্থমন্ত্রী ছাড়াও সেখানে উপস্থিত ছিলেন মার্কিন সরকারের আফ-পাক বিষয়ক কর্তা ড্যান ফেল্ডম্যান। গোটা ঘটনায় ক্ষুব্ধ নয়াদিল্লি। বিদেশ মন্ত্রক সূত্রের খবর, স্থির হয়েছে কূটনৈতিক পথে প্রতিবাদ জানানো হবে ওয়াশিংটনের কাছে।
গিলগিট বালটিস্তানের কাছে এই সাড়ে চার হাজার মেগাওয়াটের দায়ামার-ভাসা জলবিদ্যুৎ ও সেচ প্রকল্পটিতে নাক গলানোর জন্য অতীতে বেজিংয়ের সঙ্গেও কূটনৈতিক যুদ্ধে নেমেছিল ভারত। চিন এই প্রকল্পের মাধ্যমে পাক অধিকৃত কাশ্মীরে নিজেদের পরিকাঠামো বানাতে শুরু করেছিল বলে সাউথ ব্লকের অভিযোগ। বিদেশ মন্ত্রকের গোয়েন্দা রিপোর্টে অনুমান বেজিং ওই খাতে অন্তত ১২০০ কোটি ডলার বিনিয়োগও করেছে এ বার আমেরিকাও ওই প্রকল্প নিয়ে উৎসাহ দেখানোয় রক্তচাপ বেড়েছে ভারতের।
পাকিস্তান এর আগে ওই প্রকল্পের জন্য বিশ্ব ব্যাঙ্কের কাছেও অর্থ সাহায্যের আর্জি জানিয়েছিল। ভারতের তীব্র আপত্তি এবং ওই এলাকাটি যে বিতর্কিত এই দু’টি বিষয় মাথায় রেখে বিশ্ব ব্যাঙ্ক ফিরিয়ে দেয় পাক আবেদন। এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্ক (এডিবি)-ও উৎসাহ দেখায়নি। নয়াদিল্লির আশঙ্কা, আমেরিকার এই নয়া উদ্যোগ বিশ্ব ব্যাঙ্ক বা এডিবি-কেও নতুন করে ভাবাতে পারে।
ভারত-পাক সম্পর্কে এতে খারাপ প্রভাব পড়তে পারে বলে মনে করছেন কূটনীতিকরা। কারণ, এমন একটি সময়ে ওয়াশিংটনে ওই বৈঠকটি হল, যখন কাশ্মীর প্রসঙ্গকে আন্তর্জাতিক বিষয় করে তোলার চেষ্টা চালাচ্ছে নওয়াজ শরিফের সরকার। কিছু দিন আগেই পাক রাষ্ট্রদূত দিল্লিতে কাশ্মীরি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সঙ্গে বৈঠক করায় ভেস্তে গিয়েছে দু’দেশের মধ্যে সচিব পর্যায়ের আলোচনা। গত এক মাস ধরে উত্তপ্ত হয়ে রয়েছে সীমান্ত। প্রায় নিয়মিতই ভারত-পাক নিয়ন্ত্রণ রেখায় সংঘর্ষবিরতি লঙ্ঘন করে চলেছে পাক সেনা। নিয়ন্ত্রণ রেখার কাছে সাধারণ গ্রামবাসীদেরও নিশানা করছে তারা। এই সবের জেরে আসন্ন সার্ক সম্মেলনে ভারত এবং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকও অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। এই পরিস্থিতিতে কাশ্মীরের যে অংশটি পাকিস্তান বেআইনি ভাবে দখল করে রেখেছে, সেখানেই বিদ্যুৎ প্রকল্প গড়তে ওয়াশিংটনের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়াটাকে নেতিবাচক সঙ্কেত বলে মনে করছে সাউথ ব্লক।
প্রশ্ন হল, কেন এমনটা করছে আমেরিকা? কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আমেরিকা বরাবরই ভারত ও পাকিস্তান সম্পর্কে ভারসাম্যের নীতি নিয়ে চলে। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে পাক অধিকৃত কাশ্মীরের প্রকল্পের জন্য টাকা তোলার অনুষ্ঠানটি করা হয়েছে গত সপ্তাহে, অর্থাৎ ম্যাডিসন স্কোয়ারে নরেন্দ্র মোদীর বক্তৃতার দিন দশেক পরেই! উপস্থিত ছিলেন পাক অর্থমন্ত্রী ইশাক ডর, প্রতিরক্ষা ও জলবিদ্যুৎ সংক্রান্ত মন্ত্রী খাওয়াজা মহম্মদ আসিফ প্রমুখ। পাকিস্তানে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত রিচার্ড ওলসন সম্প্রতি লাহৌরে এ-ও বলেন, “বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে প্রকল্পটি মুনাফার আকর্ষণীয় সুযোগ তৈরি করে দিতে পারে। পাকিস্তানেরও এই মহূর্তে প্রবল ভাবে জল এবং বিদ্যুৎ ক্ষেত্রে বিদেশি বিনিয়োগ প্রয়োজন।”
কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞের ব্যাখ্যা, আমেরিকা দু’দেশের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রেখে চলার নীতি নিয়ে চললেও পাকিস্তানে ওসামা বিন লাদেনের নিধনের পরে সেই ভারসাম্যের ভরকেন্দ্র ইসলামাবাদ থেকে সাময়িক কিছুটা সরে এসেছিল। কিন্তু ওয়াশিংটনের পাক-নির্ভরতা একেবারে চলে গিয়েছে এমনটা নয়। হোয়াইট হাউস এ কথা জানে যে, আফগানিস্তানে তালিবানদের সঙ্গে যুদ্ধের প্রশ্নে পাকিস্তানের উপর নির্ভর করা ছাড়া গতি নেই। তাই এক দিকে ভারতের বিরাট বাজারে উপস্থিতি বাড়ানোর আগ্রহে নরেন্দ্র মোদীকে লাল কার্পেট দিয়ে অভ্যর্থনা করার পাশাপাশি, কৌশলগত কারণেই ইসলামাবাদের মনরক্ষা করে চলাটাও জরুরি বারাক ওবামার কাছে।