‘‘তার পর কি হইল, জানো দাদুভাই’’
‘‘কি’’
‘‘রাজামশাই ঘুমের মধ্যে একখান স্বপন দ্যাখলো। দ্যাখলো, আকাশ থিকা লামইয়া আইলেন ভগবান। রাজারে কইলেন, কাইল সকালে স্নানের সময় আমি একখান দারুখণ্ড হইয়া, ভাসইয়া আসুম—’’
বাঁধা দিয়ে, ঘুম-ঘুম চোখ তুলে আট-দশের বালক জিজ্ঞেস করল, —‘‘দারুখণ্ড কি, দিদা?’’
‘‘কাষ্ঠখণ্ড। মাঝারি সাইজের কাঠের টুকরো।’’
সেই বালক-বয়সের ছোট্ট জগতে নানা রূপে ঈশ্বরের প্রবেশ। দিদিমার দৌলতে বহু তীর্থ একাধিক বার ঘোরা হয়েছে। গরমের ছুটিতে চার-পাঁচ বার গেছি পুরীতে। কাশিতেও বার তিনেক। দিদিমা যেতেন বিশ্বনাথ বা জগন্নাথ মন্দিরে পুণ্য করতে। আমি নোনা জল ঘাঁটতুম, ঝিনুক কুড়োতুম। নুলিয়ার শক্ত হাত ধরে সমুদ্রে যেতুম। কথকতা শুনতুম দশাশ্বমেধ ঘাটের প্রাচীন সিঁড়িতে বসে। মনে মনে কল্পনা করতুম, জগন্নাথ আর বিশ্বনাথ দু’জনে ভাই-ভাই।
পরে, পরিণত বয়সে সেই গল্পের খেই ধরেছি লোকমুখে, বইপত্রে ‘রথযাত্রা’র উৎস সন্ধান’ করতে গিয়ে। আমাদের দেশের রাজা-মহারাজা-জমিদারদের রাজ্য বা জমিদারি না থাকলেও তাঁদের বংশ পরিচয়ে এখনও ‘রাজা’। বর্তমান ‘রাজার’ পূর্বপুরুষই স্বপ্নে পেয়েছিলেন উক্ত ‘দারুখণ্ড’। তৎকালীন শিল্পীরা সেটিকে পরিষ্কার করে, রং-চং দিয়ে মূর্তি বানিয়ে স্থাপন করলেন এবং মন্দির গড়ে উঠল। ক্রমে ক্রমে ভক্ত, দর্শনার্থীর ভিড় বাড়তে লাগল। পুরোহিত পাণ্ডাদের সংখ্যাও প্রচুর। সারা বছর ধরে ধূপ-ধুনো-ফুল-মালা, নানান আচার-উপাচারের ফলে দিনে দিনে অবক্ষয়ের শিকার হলো কাষ্ঠখণ্ডটি। রং মলিন হয়ে গেল। কাঠের চলটা উঠতে লাগল। বছর খানেক বাদে, মন্দির কর্তৃপক্ষ ঘোষণা করলেন, ‘‘জগন্নাথদেবের জ্বর হয়েছে। দশ দিনের জন্যে দ্বার বন্ধ থাকবে। ভক্ত দর্শনার্থী এই দশ দিন তাঁকে বিরক্ত করতে পারবেন না।—‘‘সেই নিয়ম অদ্যাবধি বিরাজমান।
তা, সেই দশ, না পনেরো দিনে মন্দির কর্তৃপক্ষকে বহু কাজ সামলাতে হয়—বহমান প্রথা সংরক্ষণের প্রয়োজনে পুরোনো কাষ্ঠখণ্ডটি জলে বিসর্জন দেওয়া হয় এবং নতুন কাঠের খণ্ড এনে, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে নানান রংয়ে সেটি আঁকা হয়। তার পর সাজগোছ করে বসানো হয় রথে। বলরাম-সুভদ্রাও সঙ্গে থাকেন—আলাদা আলাদা রথে। ঘোষণা জানায়: ঠাকুর সুস্থ হয়েছেন। স্নান করেছেন। এ বার শুরু হবে তাঁর রথযাত্রা উৎসব। ভক্ত ভেঙে পড়েন ঠাকুরকে দেখতে, স্পর্শ করতে। স্নানযাত্রা বা রথযাত্রা সম্পর্কে কথিত আছে, —রথের আগমন পথে দাঁড়িয়ে তাঁকে শ্রদ্ধা জানালে, মানুষের পাপক্ষয় হয়।—রথের সঙ্গে সঙ্গে দেবতাকে অনুসরণ করলে, নিম্নবর্ণের মানুষ অথৈ ঐশ্বর্যে সমৃদ্ধ হতে পারেন। —নাচতে নাচতে, ঠাকুরের জয়গানে কণ্ঠ মেলালে ধ্যান থেকেও বেশি আত্মার উন্নতি হয়। —এই উৎসবে যোগদান করে, যে কোনও ভাবে একে সফল হতে সাহায্য যিনি করেন, জগন্নাথদেব তাঁকে যৎপরোনাস্তি আশীর্বাদে ভূষিত করেন। —রথযাত্রার জন্যে যিনি সময়-শ্রম- ধান করেন—তাঁর গৃহ সংসার এবং নিকট জন সকলেই দেবতার আশীর্বাদে ধন্য হন।
উপরোক্ত কথাগুলিকে হয়তো অনেকে অতিশয়োক্তি মনে করবেন, কিন্তু অধ্যাত্ববিজ্ঞান সম্পর্কে যে সকল ভক্তরা ওয়াকিবহাল, তাঁরা এই পঞ্চশুদ্ধিতে বিশ্বাস করেন।
সেই ছেলেবেলাতেই দিদিমার মুখে শুনেছি গান। দুলে দুলে, দন্তবিহীন ফোকলা মুখে দেবতার নাম গান,
‘‘ভক্ত শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য প্রভু নিত্যানন্দ
হরেকৃষ্ণ হরেরাম শ্রী রাধে-গোবিন্দ
ভক্ত শ্রীকৃষ্ণ—’’
জিজ্ঞেস করেছিলুম দিদিমাকে,
‘‘এই চৈতন্য কে, দিদা?’’
‘‘আহা-হা। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু,’’ বলেই জোড়হাত মাথায় ঠেকিয়ে প্রণাম করতেন। বলতেন, ‘‘উনি হলেন সাক্ষাৎ ভগবান। নদের নিমাই হয়ে মর্ত্যে অবতীর্ণ হয়েছিলেন—শ্রীকৃষ্ণের নামগান প্রচার করতে করতে বিভোর হয়ে যেতেন—’’ বলে, আমার অনিচ্ছাসত্ত্বেও ধরে নিয়ে গেছেন এক দিন সেই রথযাত্রা উৎসবের উৎসে। জগন্নাথ মন্দিরে সেই বালক বয়সে এক বারই ঢুকেছিলুম। আবছা মনে পড়ে সেই আধো-অন্ধকার বিশাল হলঘর। গিজগিজ করছে শরণার্থীদের ভিড়। অজস্র মানুষের গুঞ্জন, মন্ত্রপাঠের ধ্বনি। আমার খালি-পায়ের তলায় কেমন যেন প্যাঁচপেঁচে কাদার মতো লাগছে। ঘোর অন্ধকার মেঝে একেবারে কনকনে ঠান্ডা। কত শত বা সহস্র বছর রোদ পায়নি এই পাথরের ঘর, দেওয়াল। ফুল-পাতা-ভোগ ও সম্মিলিত অসংখ্য ভক্তদের স্বেদ মিলেমিশে এক বিচিত্র স্যাঁতসেঁতে, দমচাপা গন্ধ। সেই ঠাসাঠাসি মানুষের ভিড়ে আমার দুই হাত শক্ত করে ধরেছিলেন এক দিকে উৎকলবাসী পাণ্ডা (যাঁর মালকোচা-মারা হেঁটো ধুতির নীচের অংশে পা জোড়া অসম্ভব ফোলা ছিল, মনে আছে, পরে জেনেছিলুম, ওটি উড়িষ্যাবাসীর প্রায় জাতীয় রোগ—গোদ) অন্য দিকে দিদিমা। দু’জনে আমাকে নিয়ে নিয়েছিলেন একেবারে পেছনের দেওয়ালের গায়ে।
দিদার নির্দেশে পাণ্ডামশাই আমাকে কোলপাঁজা করে ওপরে তুলেছিলেন, স্পষ্ট মনে আছে। পেছনের দেওয়ালের দিকে দেখিয়ে দিদিমা বলেছিলেন, ‘‘দাদুভাই, দেওয়ালে হাত-বুলিয়ে দ্যাখো তো?’’
তখন আমার চোখের সামনে আলো-অন্ধকারে, কষ্টি পাথরের মতোন ঘোর কালো, ভেজাভেজা, দেওয়াল। হাত বোলাতে বোলাতে চোখ একটু সয়ে যেতে দেখলুম, যেন বিশাল একটি পাঞ্জার ছাপ। মনে হবে, কাঁচা মাটির মত পাথরে কেউ বাঁ হাতের ভর দিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। সেই ছাপে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করেছিলুম দিদিমার নির্দেশে। তখন, সেই বয়েসে কিছুই বুঝিনি। আজ ভাবলেও কেমন যেন মন ভরে যায়। দিদা বলেছিলেন, ‘‘শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর হাত। ওই খানে হাত রেখে উনি ধ্যানমগ্ন হয়েছিলেন। মন্দিরে এসে, ওঁর ভর হয়েছিল।’’
....সম্বৎসর জ্বর নিরাময় হওয়ার পর জগন্নাথ ঠাকুর তাঁর মাসির সঙ্গে দেখা যান রথে চেপে। ‘মাসির বাড়ি বলতে, খানিক দূরে ‘গুন্ডিচাবাড়ি’র মন্দিরে। সেখানেই ‘মাসি’র আদর যত্নে দিন সাতেক থেকে উল্টোরথে ফিরে আসেন স্বগৃহে, মন্দিরে। যে বাস্তব কারণে ‘ঠাকুরের জ্বর’ হয় এবং পরে স্নানযাত্রা-রথযাত্রা উৎসবের মধ্যে দিয়ে ভক্তদের কাছাকাছি হন, প্রায় সেই জাতীয় বাস্তবিক কারণেই তাঁকে মাসির বাড়িতে যেতে হয়। শুনেছি সারাটা বচ্ছর ধরে বিশ্বাসী মানুষ-মানুষের ভিড় জমাট বেঁধে থাকে পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে। ফলে, মন্দিরের অভ্যন্তর, গর্ভ গৃহকে ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার করার দরকার হয়। অন্তত বছরে এক বার। তার পর, নতুন কাষ্টখণ্ডে রং ইত্যাদি করতে গিয়েও অন্তঃকক্ষে অবাঞ্ছিত পদার্থ যা জমে- সে সব সরিয়ে ঝকঝকে, শুকনো করে, মন্দিরটিকে স্বাস্থ্যসম্মত, সুজ্জিত করা হয়ে থাকে। উল্টো রথে ফিরে এসে আবার একটি বছরের জন্যে ভ্রাতা-ভগিনীর সঙ্গে রথযাত্রার জগন্নাথ সিংহাসনে আসীন হন।
জগন্নাথ দেবের আমাদের দেশে তাবৎ পূজা-অর্চনা উৎসবের পিছনে কোনও কাহিনি থাকে। বিভিন্ন সময়ে, প্রাজ্ঞ পণ্ডিতগণ সেগুলিকে ‘গল্প’ হিসেবে সাজিয়ে পরিবেশন করেন সাধারণ জনতাকে। অবশ্যই তাঁর গূঢ় কারণও পাওয়া যাবে—হয়তো সমসময়ের সমাজ-ব্যবস্থাকে সুস্থ, সুন্দর রাখার প্রয়োজনে।
তবে, গোল বাঁধে একটাই। মূর্তিপূজোয় অন্ধবিশ্বাস তৈরি হলে মূল ঈশ্বর, ভগবান বা সর্বশক্তিমান সেই পরমাত্মার কথা, মানবজীবনের যা মূলমন্ত্র হওয়া উচিত, তার থেকে সাধারণ মানুষ সরে যেতে থাকেন। ক্রমশ আমরা বিস্মৃত বই—‘ভগবান’ বা ‘ঈশ্বর’ শব্দটি মহামানবের সমষ্ঠিগত আত্মার নাম। বিশ্বকবির রচনা মনে পড়ে এই প্রসঙ্গে:
রথযাত্রা লোকারণ্য, মহাধূমধাম
ভক্তেরা লুটায়ে পথে করিছে প্রণাম
রথ ভাবে আমি দেব,
পথ ভাবে আমি,
মূর্তি ভাবে, আমি দেব
—হাসে অন্তর্যামী।।
আরও একটি বাণী মনে পড়ছে,
বহুরূপে সম্মুখে তোমার, ছাড়ি কোথা খুঁজিছ ঈশ্বর, জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর।।
এ ভাবে রথযাত্রা পড়েছে এই পক্ষের শেষ শনিবার। স্বামী বিবেকানন্দের মহাপ্রয়াণ হয়েছিল চৌঠা জুলাই, শনিবার।
আসুন, আমরা স্বামীজিকে সশ্রদ্ধ প্রণাম জানাই, আর লক্ষ লক্ষ ধূলায় লুণ্ঠিত মানুষ-মানুষির বিশ্বাস ও ভক্তিকে জানাই অপরিসীম শ্রদ্ধা।