দুই স্ত্রী, জঙ্গলের মন্দিরে গৃহস্থ আয়াপ্পন

‘নৈষ্ঠিক ব্রহ্মচারী’ আয়াপ্পনের শবরীমালা মন্দিরে ঋতুযোগ্য নারীরা ঢুকবে কেন বলে দেশ যখন উত্তাল, পীঠাপুরম সংরক্ষিত অরণ্যে তখন লোকচক্ষুর আড়ালে নির্বিঘ্নে রয়েছে আচানকোভিল মন্দির। এখানে আয়াপ্পনের পাশে তাঁর দুই স্ত্রী পূর্ণা ও পুষ্কলার বিগ্রহ।

Advertisement

গৌতম চক্রবর্তী

কোল্লাম শেষ আপডেট: ২১ নভেম্বর ২০১৮ ০৪:৪৫
Share:

দুই স্ত্রীর সঙ্গে আয়াপ্পন।

খুঁজতে খুঁজতে অবশেষে কাল কেরল-তামিলনাড়ু সীমানায় ঘোর জঙ্গলে পাওয়া গেল তাঁকে। ‘নৈষ্ঠিক ব্রহ্মচারী’ আয়াপ্পনের শবরীমালা মন্দিরে ঋতুযোগ্য নারীরা ঢুকবে কেন বলে দেশ যখন উত্তাল, পীঠাপুরম সংরক্ষিত অরণ্যে তখন লোকচক্ষুর আড়ালে নির্বিঘ্নে রয়েছে আচানকোভিল মন্দির। এখানে আয়াপ্পনের পাশে তাঁর দুই স্ত্রী পূর্ণা ও পুষ্কলার বিগ্রহ। দুই স্ত্রী সমভিব্যহারে আয়াপ্পন রোজ পুজো পান। অন্যতম পূজারি প্রসাদ জানালেন, শবরীমালার মতো এই মন্দিরও ত্রিবাঙ্কুর দেবস্বম বোর্ডের আওতায়।

Advertisement

দুই স্ত্রী এলেন কোথা থেকে? পূজারির থেকে জানা গেল, এখানে স্ত্রী পূর্ণার সঙ্গে আয়াপ্পন রোজ পুজো পেতেন। একদা এক বণিক অনেক রেশমসম্ভার সঙ্গে নিয়ে বাণিজ্যের উদ্দেশে মাদুরাই যাচ্ছিলেন। সঙ্গে তাঁর মেয়ে পুষ্কলা। জঙ্গলের এই মন্দিরে এসে পুষ্কলা বলল, ‘বাবা, আমি এখানে আরও কিছুক্ষণ পুজোআচ্চা করি। ফেরার পথে তুমি বরং আমাকে নিয়ে যেও।’ অতঃপর জঙ্গলের রাস্তায় হাতির দল বণিকের পিছু নিল। স্থানীয় জনজাতির এক তরুণ এসে হাতি খেদিয়ে বণিককে বাঁচালেন। বণিক খুশি, যুবককে উপহার দিলেন রেশমবস্ত্র। নির্বোধ তরুণ তখনই মহার্ঘ সেই রেশমবস্ত্র গায়ে চাপিয়ে জানতে চাইলেন, তাঁকে কেমন দেখাচ্ছে। বণিক রসিকতা করলেন, ‘ঠিক বিয়ের বরের মতো।’ বাণিজ্য সেরে ফেরার পথে বণিক এখানে এসে মেয়েকে আর খুঁজে পেলেন না। শেষে মন্দিরের দরজা খুলে দেখা গেল, বিগ্রহের গায়ে জনজাতি তরুণকে দেওয়া সেই রেশমবস্ত্র। ভক্তিমতী পুষ্কলা দেবতার স্ত্রী হয়ে গিয়েছে, মর্ত্যধামে তাকে আর পাওয়া যাবে না।

হাতি এবং মাদুরাই সংযোগ এখনও রয়েছে। কোল্লম থেকে যানজটে আকীর্ণ যে রাস্তাটা ধরে ৮০ কিলোমিটার পাড়ি দিলাম, সেটাই মাদুরাই হাইওয়ে। এখান থেকে তেনমালা পাহাড় পেরিয়ে গেলেই কেরল-তামিলনাড়ু সীমানা। পূজারি বলছিলেন, কেরল ও তামিলনাড়ুর গ্রাম থেকেই এখানে বেশির ভাগ লোক আসেন। আসেন সাপে কাটার চিকিৎসা করাতে। আয়াপ্পন এখানে দুই স্ত্রী নিয়ে গৃহস্থ, বৈদ্যরাজ। সাপে কাটার চিকিৎসা করেন। মন্দিরে ছবি তোলা নিষেধ, চত্বরের এক দিকে পটে আঁকা দুই স্ত্রী-সহ আয়াপ্পন। মোবাইলে তারই ছবি নেওয়া গেল। জনসংস্কৃতি মানে শুধু টিভি এবং সিনেমা নয়, এই সব অপটু হাতে আঁকা পটচিত্রও!

Advertisement

সন্ধ্যা নেমে আসছে জভ্গলে। শবরীমালার মতো সারা দিন খোলা থাকে না এই মন্দির। সকাল ন’টায় খুলে দুপুরে বন্ধ। ফের বিকেল ৫টা থেকে রাত ৮টা। গ্রামদেবতার থান যেমন হয় আর কী! মন্দির খুললে দেখা গেল, শবরীমালার মতো এখানেও ১৮টা সিঁড়ি। তবে অষ্টধাতু নয়, সাদামাঠা পাথরের। গর্ভগৃহে প্রবেশদ্বারের দুই দিকে দুই নারীমূর্তি—পূর্ণা ও পুষ্কলা। আয়াপ্পনের বরাভয় মুদ্রায় চন্দনচিহ্ন।। চন্দন ও নানা ওষধি মিশিয়ে সাপের বিষের প্রতিষেধক তৈরির জন্য একদা এই মন্দিরের খ্যাতি ছিল, এখনও গ্রামের লোকেরা প্রায়ই আসেন। রজস্বলা কি না বিচার করে সাপে ছোবল দেয় না। ফলে নারী-পুরুষ সকলেই আসেন এখানে।

কেরলের গহন নির্জন এই সংরক্ষিত অরণ্যে সাপ আছে, আছে চিতাবাঘ। জঙ্গলের ভাঙাচোরা রাস্তায় ড্রাইভার দেখালেন, হাতির বিষ্ঠা। পাথরের ফাঁক দিয়ে বয়ে যাচ্ছে ছোট্ট আচানকোভিল নদী। পম্পার মতো এই নদীকে নিয়ে উপকথা নেই, পুণ্যার্থী এবং টুরিস্টের দল তাই আসে না। শবরীমালা আলোয় ঝলমল করে, আর দুই স্ত্রীকে নিয়ে গৃহস্থ আয়াপ্পন রয়ে যান জঙ্গলের কোণে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement