মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং নরেন্দ্র মোদী
কলকাতায় বিদ্যুৎ বণ্টনে একটি বেসরকারি সংস্থার একচেটিয়া ব্যবসাকে তিনি কেন বাঁচাতে চাইছেন, তা নিয়ে খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে পাঠানো চিঠিতে প্রশ্ন তুললেন মোদী সরকারের বিদ্যুৎমন্ত্রী রাজকুমার সিংহ।
রাজ্য প্রশাসনের একটি সূত্রের অবশ্য বক্তব্য, একটি বেসরকারি সংস্থা কলকাতা ও হাওড়া শহরে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে। যার গ্রাহক সংখ্যা ৪০ লক্ষের কিছু বেশি। পাশাপাশি, সরকার নিয়ন্ত্রিত বিদ্যুৎ সংস্থা সারা রাজ্যে বিদ্যুৎ জোগায় দু’কোটির বেশি গ্রাহককে। সুতরাং, রাজ্য কোনও বেসরকারি সংস্থার একচেটিয়া ব্যবসাকে মদত দিচ্ছে, এই ধারণা ভ্রান্ত। আর যে সংস্থার দিকে অভিযোগের আঙুল, এ বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হয়নি তারা।
মমতাকে লেখা চিঠিতে রাজকুমার জানিয়েছেন, কলকাতায় যে বেসরকারি সংস্থা বিদ্যুৎ বণ্টন করে, তারা দেশে চড়া হারে মাসুল আদায়কারী সংস্থাগুলির মধ্যে অন্যতম। কলকাতায় তাদের একচেটিয়া কারবার। বিদ্যুৎ আইনে সংশোধন করে কেন্দ্র বিদ্যুৎ বণ্টনে প্রতিযোগিতা নিয়ে আসতে চায়। একটি সংস্থাকেই নির্দিষ্ট এলাকায় বিদ্যুৎ বণ্টনের লাইসেন্স দেওয়ার প্রথা সে ক্ষেত্রে উঠে যাবে। যে সংস্থা কম মাসুলে বিদ্যুৎ এবং ভাল পরিষেবা দেবে, মানুষ তাদের কাছ থেকেই বিদ্যুৎ নিতে পারবেন। এতে কলকাতার ওই সংস্থাও প্রতিযোগিতার মুখে পড়বে।
রাজকুমার লিখেছেন, ‘আপনি কেন এই বেসরকারি সংস্থাকে প্রতিযোগিতা থেকে বাঁচাতে চাইছেন, তা স্পষ্ট নয়।’
বিদ্যুৎমন্ত্রী মুখ্যমন্ত্রীকে জানিয়েছেন, ‘দেখা যাচ্ছে, আপনার অফিসারেরা আপনাকে ঠিকমতো ব্যাখ্যা করেননি।’ এই সূত্রেই বেসরকারি ও সরকারি ক্ষেত্রে ৪০ লক্ষ ও দু’কোটি গ্রাহকের পরিসংখ্যান তুলে ধরছে সংশ্লিষ্ট সূত্র। গত বছর থেকেই মোদী সরকার বিদ্যুৎ আইনে সংশোধনে উদ্যোগী। গত বছরের বিদ্যুৎ আইন সংশোধনী বিলে আপত্তি জানিয়ে পশ্চিমবঙ্গ অভিযোগ তুলেছিল, শিল্পপতিদের স্বার্থে নতুন আইন আনা হচ্ছে। অন্যান্য রাজ্যও এতে আপত্তি তোলে।
২০২১ সালে খসড়া বদলে নতুন সংশোধনী বিল নিয়ে এসেছে কেন্দ্র। তারও বিরোধিতা করে গত মাসে মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে চিঠি লিখেছিলেন। এ বার পাল্টা জবাবে কেন্দ্রীয় বিদ্যুৎমন্ত্রী জানিয়েছেন, নতুন যে সংশোধনী বিল নিয়ে ভাবনাচিন্তা চলছে, গত বছরের বিলের থেকে তা অনেকটাই আলাদা।
মুখ্যমন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীকে অভিযোগ জানিয়েছিলেন, বিদ্যুৎ পরিষেবা সংবিধানের যৌথ তালিকাভুক্ত বিষয়। রাজ্যগুলির সঙ্গে আলোচনা না করে এ নিয়ে কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়া যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর বিরুদ্ধে। এ বিষয়ে বিদ্যুৎমন্ত্রীর যুক্তি, রাজ্যের সঙ্গে আলোচনা হয়নি বলা ভুল। রাজ্যের মতামত জানতে বিল পাঠানো হয়েছে। অঞ্চল ধরে ধরে রাজ্যগুলির সঙ্গে আলোচনাও হয়েছে।
কেন্দ্রের আইনের ধাক্কায় বিদ্যুতের মাসুল বাড়তে পারে বলে মুখ্যমন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীর কাছে আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন। এর যুক্তি হিসেবে একটি সূত্রের ব্যাখ্যা, কেন্দ্র যে নতুন নীতি আনতে চাইছে, তাতে বিদ্যুৎ বণ্টনের পরিকাঠামো তৈরির দায় এই ব্যবসায় থাকা সংস্থার না নিলেও চলবে। তার বদলে শুধু চলতি দরে বণ্টন সংস্থার কাছ থেকে বিদ্যুৎ কিনে নিজেদের মুনাফা রেখে গ্রাহকের কাছে বিক্রি করবে তারা।
ফলে, নতুন পরিকাঠামো তো হবেই না, উল্টে মাসুল বাড়তে পারে বিদ্যুতের। বিদ্যুৎমন্ত্রীর অবশ্য যুক্তি, রাজ্য বিদ্যুৎ নিয়ন্ত্রণ কমিশন মাসুলের ঊর্ধ্বসীমা বেঁধে দেবে। ফলে মাসুল বেড়ে যাওয়ার কোনও প্রশ্ন নেই। কমিশনের ক্ষমতাও ছাঁটাই করা হচ্ছে না। বরং বিদ্যুৎ বণ্টনে প্রতিযোগিতার আবহ তৈরি হলে মাসুল কমবে।
কেন্দ্রের অভিযোগ, একচেটিয়া ব্যবসার বোঝা মানুষকেই বইতে হয়। কলকাতায় চড়া বিদ্যুৎ মাসুল তার উদাহরণ। রাজ্য বিদ্যুৎ বণ্টন নিগমও বিল আদায়, বিদ্যুৎ সংবহনে লোকসানের দিক থেকে পিছিয়ে। সেই সূত্রে রাজ্য নিগমের মাসুলও দেশে অন্যতম বেশি বলে কেন্দ্রের দাবি।
মোদীকে পাঠানো চিঠিতে মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন, নতুন বিদ্যুৎ-নীতিতে লাভবান হবে মাত্র গুটিকয় সংস্থা। এত গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র থেকে সরকার ‘হাত গুটিয়ে নিলে’ দুর্ভোগ পোহাতে হবে দরিদ্র ও গ্রামীণ এলাকার মানুষকে। শুধু তাই নয়, রুগ্্ণ হয়ে পড়বে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা। বাধ্য হবে শুধুমাত্র কম চাহিদা ও মুনাফার সেই সমস্ত অঞ্চলে বিদ্যুৎ জোগাতে, বেসরকারি সংস্থা যেখানে পা রাখার আগ্রহ দেখাবে না। তাঁর অভিযোগ, কেন্দ্র বিকল্প বৃদ্ধির কথা বলছে। কিন্তু ইচ্ছেমতো বিদ্যুতের মাসুল বাড়িয়ে আসলে এতে লাভবান হবে শুধু নতুন পরিষেবা সংস্থাগুলি। সমস্ত ক্ষেত্রে তার মাসুল গুনতে হবে মানুষকেই।