সড়কের এক দিকে আলোচনাপন্থী আলফার শিবির, অন্য দিকে টানা চা-বাগান। বাগান শ্রমিকদের পাশাপাশি, হিন্দিভাষীদেরও বিরাট বসতি এখানে। তিনসুকিয়া, কাকোপথার, বিজুলিবন—ভূমিপুত্র বনাম বহিরাগতের সেই তীব্র লড়াই এখন অতীত। কিন্তু তার চোরাস্রোত এখনও বইছে তিনসুকিয়া জেলাজুড়ে। এক দিকে ধেমাজি, অন্য তিন দিক ঘিরে রয়েছে অরুণাচল প্রদেশ। আলফার প্রধান ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত তিনসুকিয়ায় এখন হিন্দিভাষীরা উভয় সঙ্কটে। আলোচনাপন্থী আলফা তাদের কাছ থেকে ‘তোলা’ আদায় করে। আর সংগ্রামপন্থীরা সুযোগ পেলেই করে আক্রমণ। ভরসা ছিল বিজেপিতে। কিন্তু সেই বিজেপিও প্রার্থী হিসেবে দাঁড় করিয়েছে প্রাক্তন এক আলফা জঙ্গিকেই।
উজানি অসমের প্রধান ব্যবসাকেন্দ্র এই তিনসুকিয়া। আর ব্যবসার হাত ধরেই বিস্তর অবাঙালি পরিবারের কয়েক পুরুষের বাস এখানে। কিন্তু আজও ঘোচেনি তাদের ‘বহিরাগত’ তকমা। সেই আশির দশকে আলফার যখন রমরমা, তখন পরেশবাহিনীর মূল আক্রমণের লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল এই হিন্দিভাষীরাই। তিনসুকিয়ার এক পুরনো ব্যবসায়ী, রমেশ ধান্দারিয়ার কথায়, ‘‘তখন জলের মতো টাকা দিতে হত। তারপরেও বাঁচার কোনও নিশ্চয়তা ছিল না।’’ ২০০০ সালে আলফা এই জেলাতেই শতাধিক হিন্দিভাষীকে গুলি করে মারে। ২০০৩ ও ২০০৭ সালেও চলেছে হিন্দিভাষী নিধন।
এক দিকে জঙ্গিদের দৌরাত্ম্য, অন্য দিকে সরকারি অবহেলা। তার পরিবর্তন চেয়েই এক দশক আগে গো-বলয়ের দল বিজেপিকে অসমে এনেছিলেন হিন্দিভাষীরা। কার্যত এখনও বিজেপির প্রধান ভোটব্যাঙ্ক ধরা হয় এই হিন্দিভাষীদেরই। কিন্তু তাতে হিন্দিভাষীদের অবস্থা পাল্টায়নি। সংগ্রামপন্থী আলফা নেতা পরেশ বরুয়া এখনও হিন্দিভাষীদের হুমকি দেন। গত বছর বিজুলিবনেই ব্যবসায়ী নন্দলাল সাহু আর তাঁর কন্যা কাজলকে গুলি করে হত্যা করে আলফা জঙ্গিরা। কাকোপথারে আলফা শিবিরের প্রায় উল্টোদিকেই ম্যাকলয়েড রাসেলের চা-বাগান। সেখানে শিবিরের সদস্যদের অবাধ যাতায়াত। বাগানের তরফে শিবিরে নিয়মিত মাসোহারা পাঠাতেই হয়। ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলিরও একই অবস্থা। উল্লেখযোগ্য অনুপস্থিতি পুলিশের। অথচ চায়ের শহর হিসেবে পরিচিত তিনসুকিয়ায় ব্যবসার সিংহভাগ নিয়ন্ত্রিত হয় হিন্দিভাষীদের হাতেই। তেমনই লিডু-মার্গারিটার কয়লার ব্যবসাও হিন্দিভাষীদের হাত ধরেই ছড়াচ্ছে। বিজুলিবনের শাহ পরিবারের সদস্য অক্ষয়লাল শাহও গত বছর আলফার আক্রমণে হাতে-পায়ে গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন। তাঁর কথায়, ‘‘জঙ্গিদের গুলিতে আমাদের পরিবারের দু’জন মারা গেল। আমার নিজের গুলি লাগল। পুলিশ এসে দোষীদের ধরার, এলাকায় পুলিশ ফাঁড়ি বসানোর প্রতিশ্রুতিও দিল। কিন্তু কোথায় কি!’’ নন্দলালের বৌদি, লক্ষ্মীদেবীর ক্ষোভ, ‘‘আসলে সব দলই আমাদের কাছ থেকে ভোটটুকু চায়। এরা কেউ আমাদের অসমের মানুষ বলে মনে করে না। তাই আমাদের নিরাপত্তা বা উন্নয়নে কারও নজর নেই। অথচ আমাদের ব্যবসা থেকে কিন্তু রাজ্যেরই লাভ হয়।’’
রাজ্যের মোট ভোটারের মধ্যে হিন্দিভাষী ভোটার ৬ শতাংশ হলেও তিনসুকিয়া জেলায় কিন্তু তারাই ‘কিংমেকার। এখানকার পাঁচটি বিধানসভা কেন্দ্রের মধ্যে গত বার চারটিতে কংগ্রেস জিতেছিল। এর মধ্যে শদিয়ার বলিন চেতিয়া দলবদল করে এখন বিজেপিতে। একমাত্র বিজেপি বিধায়ক আছেন ডুমডুমায়। দিলীপ মরাণ। তিনসুকিয়ায় বিজেপির প্রার্থী হিসেবে লড়ছেন সঞ্জয় কিষাণ। তিনি কিন্তু শুধুমাত্র হিন্দিভাষী ভোটের উপরে নির্ভর করতে চাইছেন না। তাঁর কথায়, ‘‘হিন্দিভাষীরা বিজেপিকে রাজ্যে জমি দিলেও এখন পরিস্থিতি বদলেছে। গোটা অসমের মানুষ এখন বিজেপিকে তাদের একমাত্র বিকল্প বলে মনে করছেন। তাই শুধুমাত্র হিন্দিভাষীদের দল হিসেবে পরিচিতি বিজেপির পরিধিকে ছোট করে দেয়। তবে আমি জিতলে তিনসুকিয়ায় হিন্দিভাষীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করায় সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেব।’’
স্থানীয় স্কুলশিক্ষক মনোজ ওঝা বা শহরের ব্যবসায়ী কৈলাশ সাহুদের মতে, আসলে হিন্দিভাষীরা হল অসমের অভিভাবকহীন সম্প্রদায়। বাঙালিরা অনেক বছর ধরে অসমে আছেন। ‘বাঙালি খেদাও’ আন্দোলনের পরে তাদের বন্ধন আরও মজবুত হয়েছে। বরাক উপত্যকা বাঙালির নিজের দুর্গ। কিন্তু হিন্দিভাষীরা রাজ্যের বাণিজ্যের প্রধান চালিকাশক্তি হলেও সমাজ বা রাজনীতিতে তাদের কোনও স্থান বা মর্যাদা নেই। গুয়াহাটি, ধুবুরি, নগাঁওয়েও একই ছবি। অথচ রাজনৈতিক নেতা হোক বা জঙ্গি নেতা, হিন্দিভাষীদের কাছে হাত পাততে কারও কুন্ঠা নেই।
বিজুলিবনের মানুষ কংগ্রেসের অবহেলা আর আলফার আতঙ্কে ক্ষুব্ধ হয়ে ভেবেছিলেন বিজেপিকেই ভোট দেবেন। তাঁরা পড়ছেন মার্গারিটা কেন্দ্রে। সেখানে বিজেপি প্রার্থী করেছে প্রাক্তন আলফা নেতা ভাস্কর শর্মাকে। এই ভাস্কর শর্মার বিরুদ্ধে গুপ্তহত্যার বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। সংগ্রামপন্থী আলফার সভাপতি অভিজিৎ অসম এলাকাবাসীকে রীতিমতো হুমকি দিয়ে বলেছেন, ‘‘গুপ্তহত্যার নায়ক ভাস্কর শর্মার সভায় গেলে বা তাঁকে সমর্থন জানালে ফের আক্রমণ চালানো হবে।’’ এ দিকে আলোচনাপন্থী আলফার তোলাবাজ চেহারা দেখেও আতঙ্কিত এলাকাবাসী। তেমনই একজনের হাতে ক্ষমতা তুলে দিলে ভবিষ্যৎ কেমন হবে তা নিয়ে হিন্দিভাষীরা উদ্বিগ্ন। এলাকার বাসিন্দা সহদেব শর্মা বলেন, ‘‘আমরা সাধারণত বিজেপির দিকেই ঝুঁকে থাকি। কিন্তু একজন ‘সালফা’(সারেন্ডার্ড আলফা) বিধায়ক হিসেবে কেমন হবেন তা নিয়ে আমার দ্বিধাগ্রস্ত।’’ তিনসুকিয়ার বর্তমান কংগ্রেস বিধায়ক রাজেন্দ্রপ্রসাদ সিংহ নিজে আদতে বিহারের লোক। তাঁর মতে, হিন্দিভাষীদের রক্ষাকর্তা হিসেবে বিজেপি নিজেদের প্রচার করলেও ওই সম্প্রদায় থেকে তারা তেমন বেশি প্রার্থী দেয়নি। এর মূল কারণ, তারা হিন্দিভাষী-বিরোধী হিসেবে পরিচিত অসম গণ পরিষদের সঙ্গে জোট করেছে। তাঁর আশা, এমন জোটকে নিশ্চয় হিন্দিভাষীরা ভরসা করবেন না!