‘গ্রাউন্ড জ়িরো’ বুল গড়হী গ্রামটিকে রাতারাতি দুর্গ বানিয়ে ফেলা হল। ছবি: পিটিআই
বাজরার খেতে নির্যাতিতার রক্তের দাগ এক পক্ষকালে হয়তো মিলিয়ে গিয়েছে।
কিন্তু ডিজেল ঢেলে পুড়িয়ে দেওয়ার পরেও যদি কোথাও কোনও স্ফুলিঙ্গ থেকে থাকে, তার জেরে যদি ক্ষোভের আগুন আরও বেড়ে যায়? সেটা হতে দিতে নারাজ যোগী আদিত্যনাথের প্রশাসন। আর তাই সেই ছাই সম্পূর্ণ চাপা দেওয়ার জন্য বৃহস্পতিবার ভোর থেকে এক অভিনব আয়োজন।
উত্তরপ্রদেশের হাথরস থানা এলাকায় দলিত কন্যার উপরে অত্যাচারের ‘গ্রাউন্ড জ়িরো’ বুল গড়হী গ্রামটিকে আজ রাতারাতি দুর্গ বানিয়ে ফেলা হল। সংবাদমাধ্যম দূরস্থান, উপর থেকে নির্দেশ, ‘বাইরের মশামাছিও যেন ব্যারিকেড গলে ঢুকে পড়তে না পারে এই গ্রামে’।
‘চুপ! তদন্ত চলছে।’— সকাল থেকে সংবাদমাধ্যমকে এই মর্মেই শাসিয়ে গেল যোগী আদিত্যনাথের পুলিশ। যে সব রাজনৈতিক নেতা-কর্মীরা বিক্ষোভ দেখিয়ে ঢুকতে গিয়েছেন, তাঁদেরও লাল চোখ দেখানো হয়েছে বলে অভিযোগ।
আরও পড়ুন:ধর্ষণই হয়নি, বলছে পুলিশ
গোটা দেশে বিক্ষোভের আকার দেখে নড়ে বসেছে দিল্লি। আর দিল্লির ফোনে ওই নির্যাতন কাণ্ডের ১৫ দিন পরে সক্রিয় হয়েছে লখনউ। তার জেরেই সিট বা বিশেষ তদন্তকারী দল আজ গ্রামের ভিতরে। সর্বোপরি ওই কিশোরীর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে এই সব ‘নড়াচড়া’র ভিতরেই উত্তাল হয়ে উঠল মোদী-যোগী বিরোধী রাজনীতি। আজ রাহুল-প্রিয়ঙ্কা গাঁধীর দিল্লি থেকে হাথরস-যাত্রা গ্রেটার নয়ডা এক্সপ্রেসওয়েতে এসে থেমে গেল ঠিকই। কিন্তু যোগীর কোর্টে পাল্টা লড়াই ছুড়ে দিতে কসুর করেননি তাঁরা। ২০২২-এর উত্তরপ্রদেশের ভোটে যোগী জমানায় দলিত ও নারী নির্যাতনকে এখন থেকেই রাজনীতির অস্ত্র করে তুললেন।
এমনিতে গত বেশ কয়েক মাসে বিজেপির বিরুদ্ধে বিশেষ মুখ না-খোলা ‘দলিত কি বেটি’ তথা বিএসপি নেত্রী মায়াবতীও আজ দাবি তুললেন, হয় যোগীকে মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে সরানো হোক, না-হলে রাষ্ট্রপতি ভয় দেখিয়ে গ্রাম ঘিরল শাসন জারি হোক।
মায়াবতীর কটাক্ষ, ‘‘যোগীকে গোরক্ষনাথের মঠে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হোক। না হলে অযোধ্যায়। মুখ্যমন্ত্রীর পদে কোনও দক্ষ ব্যক্তি দরকার।’’ যোগীকে নিশানা করে প্রিয়ঙ্কার মন্তব্য, ‘‘নিজেদের যারা হিন্দু ধর্মের রক্ষাকর্তা বলে, তারাই একজন বাবাকে মেয়ের চিতাও জ্বালাতে দেয়নি!’’
আজ সকাল থেকে হাথররের বুলগড়ী গ্রামে পুলিস-প্রশাসন হাওয়ায় ভাসিয়ে দিয়েছিল করোনার গল্প! গ্রামের ভিতরে প্রহরারত তিন পুলিশ-কর্মীর না কি করোনা ধরা পড়েছে। সেই জন্যই না কি গোটা গ্রাম ‘কন্টেনমেন্ট জ়োন’-এ। নির্যাতিতার পরিবারের সঙ্গেও দেখা করা যাবে না।
‘করোনার জের’— এই শব্দকে বর করেই আজ লখনউ হাইওয়ে থেকে বাঁ দিকে মোড় নেওয়া মাত্রই দেখা গেল গোটা এলাকা পুলিশে ছয়লাপ। যত গ্রামের দিতে এগোনো যাচ্ছে, ততই বাড়ছে পুলিশের সংখ্যা। ব্যারিকেডের ঠিক পাশেই গলা ফাটিয়ে ধর্নায় অখিলেশ যাদবের দলের মাঝারি মাপের নেতা-কর্মীরা।
মাঝে মাঝেই তাঁরা গ্রামের ঢোকার চেষ্টা করছেন। স্লোগান তুলছেন, ‘ইউপি পুলিশ কি তানাশাহি নেহি চলেগা।’ গ্রামে রয়েছে একটি স্বাস্থ্যকেন্দ্র। সেখানে কর্মরত এক দলিত যুবক (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) গ্রাম থেকে বেরনোর অনুমতি পেয়েছিলেন। পুলিশের সামনে কথা বলতে চাইলেন না। একটু দূরে গিয়ে তাঁকে ধরা গেল। তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বললেন, ‘‘মিডিয়া আজ এই নিয়ে হইচই করছে। এমনটা তো নতুন কিছু নয়। অত্যাচার নানা ভাবে হয়। কাল রাতেই তো জনা পনেরো বিজেপি-র উচ্চবর্ণের নেতা এসে ঘরে ঘরে শাসিয়ে গিয়েছেন মিডিয়ার সামনে মুখ না খুলতে। আজ তো দেখছি, বন্দিই করে দিল।’’
দিল্লির নির্ভয়া-র পরিবারের আইনজীবী সীমা সমৃদ্ধি কুশওয়াহা এ দিন হাথরসের দলিত পরিবারকে আইনি সাহায্য করতে চেয়ে গ্রামে ঢুকতে গিয়েছিলেন। কিন্তু গ্রামে ঢুকতে না পেরে পুলিশের সঙ্গে ঝাঁঝালো তর্ক জুড়লেন। পুলিশ-কর্মীদের চড়া সুরে চিৎকার করে বললেন, ‘‘আমাকে আটকানোর অধিকার আপনাদের নেই। যোগী আদিত্যনাথের নির্দেশই এ সব হচ্ছে।’’ তার পরেও প্রবেশের ছাড়পত্র মিলল না।
আরও পড়ুন:কৃষি আইনের বিরুদ্ধে পথে নামবেন রাহুল
সোশ্যাল মিডিয়া থেকে দিল্লির রাজপথ, এমনকী গ্রেটার নয়ডা এক্সপ্রেসওয়েও যখন বিক্ষোভে উত্তাল, তখন যোগীর গড়ে এই উষ্মাকে কাজে লাগাতে কংগ্রেস, এসপি, বিএসপি বা অজিত সিংহের দলের শক্তিপ্রদর্শনে ভাটার টান। রাজ্যের কংগ্রেস নেতাদের হাথরসে দেখা মিলল না। আম আদমি পার্টির জনা দশেক নেতা-কর্মী একবার বিক্ষোভ দেখিয়ে গেলেন। মায়াবতীর দলের কোনও বড়-ছোট বা মাঝারি মাপের নেতাকে চোখেই পড়ল না।
দিনভর রোদ্দুরে দাঁড়িয়ে যাঁরা ব্যারিকেডের ওপারে অবিশ্রাম যোগীর পুলিশ-প্রশাসনের দিকে অভিশাপ ছুড়ে দিলেন, তাঁদের গায়ে কোনও রাজনীতির তকমা নেই। তাঁরা আশেপাশের গ্রাম থেকে আসা সাধারণ দলিত সমাজের প্রতিনিধি।