রায়পুরের অধিবেশনে সনিয়া ও রাহুল গান্ধী। শুক্রবার। নিজস্ব চিত্র
নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে বিজেপি পরিকল্পনা মাফিক দলিত, আদিবাসী, ওবিসি, মহিলা, তরুণ প্রজন্মের মতো প্রতিটি ‘ভোটব্যাঙ্ক’ নিজেদের দখলে আনার চেষ্টা করছে। এখন মুসলিমদের কাছেও পৌঁছতে কর্মসূচি শুরু করছে তারা। এর মোকাবিলায় ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনকে পাখির চোখ করে কংগ্রেস আজ সিদ্ধান্ত নিল, দলের সর্বোচ্চ স্তর— কংগ্রেসের ওয়ার্কিং কমিটির অর্ধেক পদ দলিত, ওবিসি, আদিবাসী, সংখ্যালঘু, মহিলা ও তরুণ প্রজন্মের জন্য সংরক্ষিত থাকবে। এ জন্য কংগ্রেসের দলীয় সংবিধানে সংশোধন করা হবে।
আজ রায়পুরে কংগ্রেসের প্লেনারি অধিবেশনের প্রথম দিনে সিদ্ধান্ত হয়েছে, কংগ্রেসের ওয়ার্কিং কমিটি গঠনের জন্য নির্বাচন হবে না। নতুন কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খড়্গেই নতুন ওয়ার্কিং কমিটির সদস্যদের বেছে নেবেন। তাৎপর্যপূর্ণ হল, এই দুই গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের সময়েই সনিয়া, রাহুল বা প্রিয়ঙ্কা গান্ধী হাজির থাকেননি। কংগ্রেস সূত্রের ব্যাখ্যা, নির্বাচিত সভাপতি মল্লিকার্জুনকে নিজের মতো দল চালানোর অবাধ স্বাধীনতা দেওয়া হচ্ছে, এমন বার্তা দিতেই এই সিদ্ধান্ত।
এক সময়ে কংগ্রেসের বিক্ষুব্ধ জি-২৩ গোষ্ঠীর নেতারা কংগ্রেসের সভাপতি পদ, ওয়ার্কিং কমিটিতে নির্বাচন চেয়েছিলেন। তাঁদের দাবি মেনে সভাপতি পদে নির্বাচন হয়েছে। আজ কংগ্রেসের স্টিয়ারিং কমিটির বৈঠকে দিগ্বিজয় সিংহ, অজয় মাকেন, অভিষেক মনু সিঙ্ঘভিরা দাবি তোলেন, ওয়ার্কিং কমিটি গঠনেও নির্বাচন হোক। কিন্তু বাকিরা তা চাননি। লোকসভায় কংগ্রেসের দলনেতা অধীর চৌধুরী যুক্তি দেন, সভাপতি নির্বাচনে মল্লিকার্জুন খড়্গে ৮৪ শতাংশ ভোট পেয়ে জিতে এসেছেন। তাই তাঁকেই ওয়ার্কিং কমিটি গঠনের অধিকার দেওয়া হোক। অনেকে যুক্তি দেন, আধ ডজন রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচনের আগে ওয়ার্কিং কমিটির জন্য ভোটাভুটি করিয়ে,
দলে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব বাড়িয়ে লাভ নেই। সেই মতোই সিদ্ধান্ত হয়েছে। ঠিক হয়, পোড়খাওয়া নেতাদের রেখে দলিত-আদিবাসী-ওবিসি-সংখ্যালঘু-মহিলা-তরুণদের জন্য জায়গা তৈরি করতে ওয়ার্কিং কমিটির বহর ২৫ জনের থেকে বাড়ানো হবে। প্রাক্তন কংগ্রেস সভাপতি, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী, লোকসভা ও রাজ্যসভায় দলনেতারা সরাসরি ওয়ার্কিং কমিটিতে চলে আসবেন।
কংগ্রেস সূত্রের ব্যাখ্যা, প্রথমত, এর ফলে সনিয়া ও রাহুল গান্ধী প্রাক্তন কংগ্রেস সভাপতি হিসেবে ও মনমোহন সিংহ প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সরাসরি ওয়ার্কিং কমিটিতে আসবেন। দ্বিতীয়ত, দলিত-ওবিসি-আদিবাসী-জনজাতি-সংখ্যালঘু-মহিলা ও বিশেষ করে ৫০ বছরের কম বয়সি নেতাদের অর্ধেক পদে রাখার শর্ত পালন করার নামে রাহুল গান্ধীর ঘনিষ্ঠ নবীন নেতারা ওয়ার্কিং কমিটিতে উঠে আসবেন।
অবশ্য গান্ধী পরিবার যে আড়াল থেকে কংগ্রেস চালাচ্ছে না, প্রকাশ্যে এই বার্তা দিতে আজ পরিবারের তিন সদস্যই দলের এই সব সিদ্ধান্ত থেকে নিজেদের দূরে রেখেছেন। কংগ্রেসের পুরনো বর্ধিত ওয়ার্কিং কমিটিই এখন স্টিয়ারিং কমিটি হিসেবে কাজ করছে। সনিয়া-রাহুল-প্রিয়ঙ্কা তার সদস্য হলেও শুক্রবার সকালে প্লেনারি অধিবেশনের শুরুতে সেই কমিটির বৈঠকে হাজির ছিলেন না। সনিয়া-রাহুল বৈঠকের পরে দুপুরে রায়পুরে পৌঁছন।
কংগ্রেস নেতারা অবশ্য মনে করছেন, সামাজিক ন্যায়ের বার্তা দিতে ওয়ার্কিং কমিটিতে দলিত-ওবিসি-আদিবাসী-সংখ্যালঘু ও মহিলা-তরুণদের জন্য অর্ধেক পদ সংরক্ষিত করার পিছনেও রাহুলের প্রভাব স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। রাহুলের ঘনিষ্ঠ কংগ্রেস নেতা কোপ্পুলা রাজুই প্রথম দলের প্রতিটি স্তরে দলিত-ওবিসি-আদিবাসী-সংখ্যালঘুদের জন্য অর্ধেক পদ সংরক্ষিত রাখার দাবি তুলেছিলেন। রাজু এআইসিসি-র তফসিলি জাতি বিভাগের প্রধান। উদয়পুরের চিন্তন শিবিরে সলমন খুরশিদ ও কোপ্পুলা রাজুর সামাজিক ন্যায় কমিটি এই প্রস্তাব দিলেও তা খারিজ হয়ে যায়। দলের প্রতিটি স্তরে ৫০ বছরের কম বয়সিদের জন্য ৫০ শতাংশ আসন সংরক্ষণের প্রস্তাবে অবশ্য চিন্তন শিবির সম্মতি দিয়েছিল। এ বার প্লেনারি অধিবেশনে দুই সিদ্ধান্ত এককাট্টা করে সর্বোচ্চ স্তরে কার্যকর হতে চলেছে।
প্রশ্ন উঠেছে, শীর্ষপদে জায়গা দেওয়ার মতো যথেষ্ট দলিত-আদিবাসী-ওবিসি-সংখ্যালঘু নেতানেত্রী কংগ্রেসে রয়েছেন তো? কংগ্রেস সূত্রের ব্যাখ্যা, আগের কমিটিতে মনমোহন সিংহ, এ কে অ্যান্টনি, মল্লিকার্জুন খড়্গে, মুকুল ওয়াসনিক, মীরা কুমারের মতো নেতানেত্রীরা ছিলেন। সেই হিসেবে তাঁরা দলিত, সংখ্যালঘু সমাজের প্রতিনিধি ছিলেন। মূল চ্যালেঞ্জ হল, তরুণদের তুলে আনা নিয়ে।
এত দিন ওয়ার্কিং কমিটিতে সভাপতি, সংসদীয় দলের নেতা ছাড়াও ২৩ জন সদস্য থাকতেন। তার মধ্যে ১২ জন নির্বাচিত ও ১১ জন মনোনীত। এখন থেকে এ ছাড়াও প্রাক্তন কংগ্রেস সভাপতি, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী, লোকসভা, রাজ্যসভার দলনেতাদের জন্য আসন বাঁধা থাকবে। রাহুল-সনিয়া-মনমোহন-অধীররা সরাসরি ওয়ার্কিং কমিটিতে চলে আসায় ওই ২৩টি পদে বাকি প্রবীণ নেতাদের রেখেও তরুণদের জায়গা করে দেওয়া যাবে বলে দল মনে করছে।