পশু দূরস্থান! মানুষের জমিই কেড়ে নিয়ে সরকারি খুঁটি পুঁতে দেওয়ার অভিযোগে সরব এখানকার অনেক গ্রাম। ফাইল চিত্র।
আমদাবাদ থেকে বারানগাঁও যাওয়ার পথে গাড়ির মধ্যে কাঠ হয়ে বসে রয়েছি। খোলা জিপে এতটা আড়ষ্ট কানহা বা জিম করবেটের অরণ্য-গভীরেও হইনি কখনও!
শুনতে হাস্যকর লাগলেও, যাত্রী নিরাপত্তা এবং ভোট বাজারের হিসাবে বিষয়টি কিন্তু আদৌ হাসির নয়। বন্ধ গাড়ির বাইরে, সামনে এবং জানলার কাচ জুড়ে প্রকাণ্ড সব মুখ! মোষ, ষাঁড় বলদের উঁকিঝুঁকি চলছে তো চলছেই হাইওয়ে জুড়ে। এক নম্বর গিয়ারে টিপে টিপে গাড়ি চালাচ্ছেন সারথি রুদ্ধশ্বাসে। আর সেই সঙ্গে বিড়বিড় স্বগতোক্তি করছেন, “এরা কাচও ভেঙে দিতে পারে, দিয়েছে এ রকম কত।”
বলদের অনন্ত মিছিল শেষে বললেন, বিশেষ করে রাতে নাকি অনেক সময়ই মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটে যায় বেওয়ারিশ পশুর কারণে। পোষার খরচ জোগাতে না পেরে আওয়ারা হয়ে যাওয়া পশুদের ছেড়ে দেয় গ্রামবাসীরা। গোশালা নামেই, পুঁজির অভাব সেখানে। সরকার আর্থিক প্রতিশ্রুতি রাখেনি। ফলে অসহায় বলদ, ষাঁড়দের জন্য রাস্তাই একমাত্র রাস্তা!
পশু দূরস্থান! মানুষের জমিই কেড়ে নিয়ে সরকারি খুঁটি পুঁতে দেওয়ার অভিযোগে সরব এখানকার অনেক গ্রাম। উত্তরপ্রদেশের মতোই গোরক্ষক বাহিনীর দাপট ও গোহত্যার উপর নিষেধাজ্ঞার জেরে চাষিদের মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠেছে বেওয়ারিশ গরু-বলদ। স্বাস্থ্য ও অন্যান্য সূচকে গুজরাত পিছনের সারিতে পড়ে থাকলেও, বেওয়ারিশ গরু-বলদের সংখ্যায় দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে।
কৃষি মন্ত্রকের কর্তারা বলছেন, গোহত্যায় নিষেধাজ্ঞা, গোরক্ষক বাহিনীর দাপটে এখন গরু জবাই বন্ধ। আগে গবাদি পশু দুধ দেওয়া বন্ধ করে দিলে বা চাষের লাঙল টানার কাজে অক্ষম হয়ে পড়লে চাষি, পশুপালকরা তাদের জবাইয়ের জন্য বিক্রি করে দিতেন। এখন তা হচ্ছে না। এ দিকে গরিব চাষি, গোয়ালাদের পক্ষে অক্ষম গরু পালন করা সম্ভব নয়। তাই তাঁরা রাস্তায় গরু-বলদ ছেড়ে দিচ্ছেন। এই সব অভুক্ত পশুই চাষের জমিতে ঢুকে ফসল নষ্ট করছে। যখন-তখন হাইওয়ে আটকে বসে থাকার ফলে সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা বাড়ছে। গ্রামে চাষিদের তাড়া খেয়ে বেওয়ারিশ গরুর পাল শহরের মধ্যেও খাবারের সন্ধানে ঢুকে পড়ছে।
গোটা দেশে পশুপালনকে কেন্দ্র করে ব্যবসা ছুঁয়েছিল সাড়ে চার লক্ষ কোটি টাকার কাছাকাছি। ক্রমশ তা পড়তির দিকে, অন্তত এই রাজ্যে। গুজরাতে মোগল আমল থেকেই প্রতিটি পঞ্চায়েতে ২০০ একর জমি চারণভূমি হিসাবে ছাড়া থাকত, যার স্থানীয় নাম চারাগা। সেখানে পশুরা চরত, জলের ব্যবস্থা থাকত।। কংগ্রেস বিভিন্ন গ্রামে প্রচারে গিয়ে যে বিষয়টি তুলছে তা হল, ক্ষমতায় আসার পর নগরায়ণের নাম করে বিজেপি তামাম চারাগা বেসরকারি সংস্থার কাছে বিক্রি করে দেয়, জল সরবরাহও বন্ধ করে দেয়। এর বিরাট অর্থনৈতিক ধাক্কা এসে পড়ে গ্রামবাসীর উপর। ব্যক্তিগত মালিকানার দুধের ব্যবসা মার খেতে থাকে। আটটি বড় মহানগর নিগমে এই ঘটনা ঘটেছে সবচেয়ে বেশি (আমদাবাদা, সুরাট, ভাবনগর, জামনগর ইত্যাদি)। কর্পোরেট সংস্থাগুলি পশুচারণের জমি নিয়ে নিচ্ছে। ঘর চালাতে না পেরে গ্রামের যুবকরা শহরে দৌড়চ্ছে মজদুরি করতে। ফলে রাজ্যের অর্থনৈতিক বৃদ্ধি ঘটলেও মানবিক সূচক পড়ে থাকছে তলানিতে। অভিযোগ, একটা পেশাকে হিন্দুত্বের প্রচারের কাজে ব্যবহার করে তার অর্থনৈতিক লাভকে খাটো করে দেওয়া হচ্ছে।
বিষয়টি এতটাই চরমে পৌঁছেছে যে, ভোটের আগে শাসক দলের কাছেও এটি চরম অস্বস্তির কারণ। বুড়ো এবং অসুস্থ হয়ে যাওয়া গরু বলদদের আশ্রয় ও চিকিৎসার জন্য গোশালাগুলিকে গত রাজ্য বাজেটে ৫০০ কোটি টাকা আর্থিক সহায়তা দেওয়ার কথা ঘোষণা করা হয়েছিল। বনসকন্ঠ পিঁজরাপোলের (গোশালা) অছি পরিষদের প্রধান কিশোর দেওড়া অন্যদের নিয়ে সেই টাকার দাবিতে রাস্তায় বসেছেন। জানিয়েছেন, এখনও একটি নয়া পয়সাও দেওয়া হয়নি।