নরেন্দ্র মোদী। ছবি: টুইটারের সৌজন্যে।
চকচকে এক্সপ্রেসওয়ে ছেড়ে রাস্তা যেখানে মোড় নিচ্ছে শহরের ভিতর দিকে, সেখানে তুমুল ভিড়। কিশোর বা সদ্য যুবকরা লাঠি হাতে নিয়ে যান নিয়ন্ত্রণে। শ’য়ে শ’য়ে মানুষ রাস্তা পারাপার করছেন। মহিলা, পুরুষ, নবীন, প্রবীণ— সকলেই রয়েছেন সে ভিড়ে। নরেন্দ্র মোদীর সভা কি এখানেই? জিজ্ঞাসা করতেই হল লাঠি হাতে দাঁড়িয়ে থাকা এক তরুণকে। তিনি বললেন, ‘‘না না, এখানে মহারাজজি এসেছেন। রামকথা হচ্ছে।’’
দক্ষিণ গুজরাত, সৌরাষ্ট্র, কচ্ছ এবং কাঠিয়াবাড় অঞ্চলে বৃহস্পতিবারই ছিল নির্বাচনী প্রচারের শেষ দিন। দক্ষিণ গুজরাতের সবচেয়ে বড় শহর সুরতে নরেন্দ্র মোদীর জনসভা এ দিনই। সেই সভায় না গিয়ে এত মানুষ ভিড় জমিয়েছেন রামকথায়! টান টান উত্তেজনার ভোট এ বার। সেই আবহেও এত মানুষ নিজেদের দূরে রেখেছেন মোদীর সভা থেকে! আশ্চর্য হতেই হল।
তবে, কি দীর্ঘ ২২ বছরের শাসকের দিক থেকে মুখ ফেরাচ্ছে গুজরাত? জবাব মিলল কিছু ক্ষণের মধ্যেই। সুরত শহরের মধ্যে বড় সমাবেশের জায়গা বিরল। তাই সভার আয়োজন হয়েছে শহরের একটু বাইরে, লিম্বায়েত বিধানসভা কেন্দ্রের নীলগিরি ময়দানে। লিম্বায়েত কোন পথে? সুরতের মধ্যে ঢোকা ইস্তক বার বার জিজ্ঞাসা করতে হচ্ছিল পথচলতি মানুষজনকে। শহরের মধ্যে বেশ কিছুটা ঢুকে বছর কুড়ির এক তরুণকে জিজ্ঞাসা করতেই তিনি বললেন, ‘‘আমি ওই পথেই কিছুটা যাব। আমাকে গাড়িতে তুলে নিন, রাস্তা দেখিয়ে দিচ্ছি।’’ অল্প ক্ষণের সহযাত্রী, কিন্তু আলাপ জমে গেল তাঁর সঙ্গে।
কী হবে ভোটের ফল? বোঝা যাচ্ছে কিছু?
‘‘কী আবার হবে! বিজেপি-ই জিতবে।’’ সোজাসাপটা জবাব তরুণের।
শোনা যাচ্ছে, সুরতের মানুষের মধ্যে প্রচুর ক্ষোভ। নোটবন্দি এবং জিএসটি নিয়ে ব্যবসায়ীদের বেজায় ক্ষোভ নাকি?
পাল্টা প্রশ্ন করলেন তরুণ, ‘‘হ্যাঁ, ক্ষোভের কথা অনেকেই বলছেন। কিন্তু তাঁরা বিজেপি-কে ভোট দেবেন না, এমনটা বলেছেন কি?’’
মানে? বিজেপির উপর রেগে রয়েছেন, তবু বিজেপি-কে ভোট দেবেন?
আরও পড়ুন: গুজরাতের মসনদে এখনও মোদীর পাদুকাই
মুচকি হাসলেন তরুণ। বললেন, ‘‘আপনি আসলে ভিডিওটা দেখেননি। হাতে হাতে ঘুরছে।’’ কী রয়েছে ভিডিওতে? ‘‘সুরত কি ব্যাপারিয়াঁ কহে রহে হয়, হম নারাজ জরুর হ্যায়, লেকিন গদ্দার নেহি হ্যায়।’’
সুরতের এই তরুণ ব্যবসাই করেন। বাবার ব্যবসায় ঢোকেননি। কলেজ শেষ করে নিজের জমা-পুঁজি একত্র করে মোবাইল ফোনের দোকান খুলেছেন। আপনার নামটাই তো জানা হল না। তরুণ বললেন, ‘‘নরেন্দ্র।’’
বাহ্, নরেন্দ্র!
আবার হাসলেন তিনি, ‘‘হাঁ, নরেন্দ্র নামওয়ালে বহত চম্কে হ্যায় ইস দেশ মে। স্বামী বিবেকানন্দ সে লে করকে, নরেন্দ্র মোদীজি তক। হমারে বিজনেস ভি চমক যায়েঙ্গে এক দিন।’’
মঞ্চে তখন মোদী।
লিম্বায়েতের নীলগিরি ময়দানে পৌঁছে টের পাওয়া গেল, তরুণ নরেন্দ্রর ভাবাবেগ খুব একটা বিচ্ছিন্ন পরিস্থিতি নয়। প্রচারের শেষ দিনে মোদীর সভা ঘিরে উৎসাহ-উদ্দীপনা ভালই। নরেন্দ্র মোদী আসার আগে বক্তব্য অনেকেই রাখলেন। তবে কারওকে নিয়েই খুব বেশি উৎসাহিত নয় বিশাল ভিড়টা। বরং কেন্দ্রীয় মন্ত্রীদের ভাষণের মাঝেই মাঠ জুড়ে বার বার রব উঠল ‘মোদী, মোদী, মোদী, মোদী...।’ আর মোদী সভাস্থলে পৌঁছতেই মুহূর্তে মাইকের আওয়াজ চাপা পড়ে গেল জমায়েতের উল্লাসের নীচে।
কী বললেন মোদী?
আরও পড়ুন: জিতলেও গুজরাতে আসন কমছে বিজেপির, ইঙ্গিত সব সমীক্ষার
বেশ অবাক করে দিয়ে হিন্দুত্বের ধারেপাশেও গেলেন না। গোটা ভাষণ জুড়ে শুধু ‘বিকাশ’, ‘বিকাশ’ আর ‘বিকাশ’। সুরতে কেমন ঝাঁ-চকচকে বিমানবন্দর তৈরি হয়েছে, তা বেশ বড়াই করেই বললেন। তবে শুধু বড় বড় বিমানবন্দর তৈরি করলেই যে বিকাশ হয় না, তাও মানলেন। বললেন, ‘‘আমার লক্ষ্য শুধু বিমানবন্দর তৈরি করা নয়। যে লোকটা হাওয়াই চপ্পল পরে ঘুরে বেড়ান, তাঁকেও হাওয়াই জাহাজে চড়ানোই আমার লক্ষ্য।’’
সুরতে মোদীর জনসভায়...ছবি: ঈশানদেব চট্টোপাধ্যায়।
প্রত্যাশিত ভাবেই কংগ্রেস তথা গাঁধী পরিবারকে এ দিনের সভা থেকেও তীব্র আক্রমাণ করলেন মোদী। কংগ্রেস ক্ষমতায় থাকলেই গুজরাত বঞ্চিত হয় বলে অভিযোগ করলেন। গুজরাতের উন্নয়নের স্বার্থে বিজেপির পাশে থাকার আবেদন জানালেন। আর সব শেষে সুর চড়ালেন সেই গুজরাতি অস্মিতায় ফিরে। নাটকীয় ঢঙে অভিযোগের আঙুল তুললেন কংগ্রেস নেতা মণিশঙ্কর আইয়ারের দিকে। নরেন্দ্র মোদী ‘নিচু জাতের’ মানুষ, বলেছিলেন মণিশঙ্কর— মনে করালেন মোদী। তার পরেই প্রশ্ন করলেন, ‘‘এতে গুজরাত আপমানিত হল কি না?’’ বিশাল ভিড় প্রত্যাশিত ভাবেই ইতিবাচক জবাব দিল। এই ইস্যুতেও কংগ্রেস বিরোধী সুর তুঙ্গে তুললেন এ বারের নির্বাচনে গুজরাত বিজেপির একমাত্র ভরসা। গুজরাতি অস্মিতার সুরটা উচ্চগ্রামে বেঁধে দিয়ে সভা ছাড়লেন।
প্রধানমন্ত্রীর মোটরকেড ধুলো উড়িয়ে বেরিয়ে যাওয়ার পরও টেলিভিশন ক্যামেরার সামনে উল্লাস চলতে থাকল— মোদী, মোদী, মোদী।