নাইজেরিয়া দেশটা কোন দিকে, সে সম্পর্কে কোনও ধারণা নেই। কিন্তু গ্রেটার নয়ডার এনএসজি কম্যান্ডো এনক্লেভের বাসিন্দা অনিরুদ্ধ সিংহ একটা বিষয়ে নিশ্চিত— ‘‘ও দেশের লোকেরা অসভ্য, জংলি! ওরা ‘নরমাংস’-ও খেতে পারে! নিজেরা ড্রাগ নেয়, ড্রাগের কারবারও করে।’’
উত্তরপ্রদেশের এই পাড়াতেই স্কুলছাত্র মণীশ কুমারের মৃত্যুর পর এলাকার লোকেরা রবিবার বি-১৪ নম্বর বাড়িতে ঢুকে পড়েন। ওই বাড়িতে পাঁচ নাইজেরীয় ছাত্র থাকতেন। তাঁদের ফ্রিজ খুলে দেখা হয়, নরমাংস রয়েছে কি না! ২০১৫-র সেপ্টেম্বরে এই এলাকা থেকে ১৩-১৪ কিলোমিটার দূরে একই ভাবে মহম্মদ আখলাখের বাড়িতেও উন্মত্ত জনতা ঢুকে পড়েছিল ফ্রিজে রাখা মাংস ‘গোমাংস’ কি না, তা যাচাই করতে! ওই পাঁচ ছাত্রের বাড়ির ফ্রিজে কিছুই মেলেনি। কিন্তু তাতে কী! অনিরুদ্ধর মতোই ওই পাড়ার অন্যরাও মনে করেন, ‘‘নাইজেরীয়রাই মণীশকে মেরে ফেলেছে।’’ কিন্তু কেন? অনিরুদ্ধর জবাব, ‘‘ওরা কাঁচা ডিম খায়! নরমাংসও খায় শুনেছি। ওরা সব করতে পারে।’’
আফ্রিকার লোকেদের সম্পর্কে এই মনোভাবের নিট ফল, গ্রেটার নয়ডার বাসিন্দারা এককাট্টা— আফ্রিকানদের আর ওই এলাকায় থাকতে দেওয়া চলবে না। অথচ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা সুবিধার জন্য প্রায় হাজার চারেক আফ্রিকান ছাত্রছাত্রী, চাকুরিজীবীর বাস গ্রেটার নয়ডায়। মণীশের মৃত্যুর পরেই ওই পাড়ার পাঁচ ছাত্রকে পুলিশ সরিয়ে নিয়ে যায়। পাড়ার আরেকটি বাড়িতে দুই ছাত্রী ভাড়া থাকতেন। তাঁদের উৎখাত করেছেন বাড়ির মালিক। আফ্রিকানদের তাড়ানোর দাবিতে মোমবাতি মিছিলও হয়। মিছিলের মুখে পড়ে চার নাইজেরীয় ছাত্র বেদম মার খেয়েছেন। যোগী আদিত্যনাথ মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর থেকেই রাজ্যের অলি-গলিতে সঙ্ঘের নেতা-কর্মীদের দাপট বেড়েছে। তাঁরাও বাড়ির মালিকদের শাসাচ্ছেন, ‘বিধর্মী’ আফ্রিকানদের আশ্রয় দেওয়া চলবে না। কিন্তু মুশকিলে পড়েছে মোদী সরকার। গ্রেটার নয়ডায় যে ভাবে তাদের ‘নরমাংস-ভোজী’ আখ্যা দেওয়া হয়েছে, তাতে আন্তর্জাতিক মঞ্চে ‘বর্ণবিদ্বেষ’-এর অভিযোগে কাঠগড়ায় উঠতে পারে বলে আশঙ্কা কেন্দ্রের।
আরও পড়ুন: মোদী সফরের আগে মাওবাদী নজরে রেল
কেন্দ্রের নির্দেশে গ্রেটার নয়ডার মিত্র এনক্লেভের যে সব পাড়ায় আফ্রিকার লোকেরা থাকেন, সেখানে এখন যোগী আদিত্যনাথের পুলিশের অতন্দ্র পাহারা। আফ্রিকানদের জন্য জারি হয়েছে ঘরবন্দি থাকার অলিখিত নির্দেশ। নাইজেরিয়া থেকে নয়ডা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে পড়তে আসা লিভিংস্টোন উগোনির মতো অনেকেই আতঙ্কে ভুগছেন। ভারতকে ঘিরে স্বপ্নভঙ্গ হয়েছে উগোনির। চিমা ওকেরির দেশের ছেলে শাহরুখ খানের অন্ধভক্ত। দেশে থাকতেই বলিউডের সিনেমা দেখে ধারণা হয়েছিল, ভারতীয়দের দরাজ দিল। এ দিন উগোনি বলেন, ‘‘এসে দেখলাম লোকে অন্য চোখে দেখে। হাসিঠাট্টা করে। কিন্তু এখন তো থাকতেই ভয় করছে। পড়াশোনার কী হবে, জানি না।’’
গ্রেটার নয়ডার বাসিন্দাদের এখন মুখে কুলুপ। কারণ, আফ্রিকানদের বিরুদ্ধে মুখ খুললেই পুলিশ ধরবে। পুলিশ সুপার সুজাতা সিংহ বলেন, ‘‘মনীশের মৃত্যুর কারণ ভিসেরা রিপোর্টে স্পষ্ট হবে। কিন্তু বাড়ির লোক নাইজেরীয়দের বিরুদ্ধে খুন, অপহরণ, নরমাংস খাওয়ার অভিযোগ দায়ের করতে চাইছে। ’’ ভারতে আফ্রিকান ছাত্রদের সংগঠনের প্রেসিডেন্ট স্যামুয়েল জ্যাক বলেন, ‘‘মানুষকে বোঝাতে হবে, আমরা ড্রাগ কারবারি নই, নরমাংসও খাই না। ’’