নরেন্দ্র মোদী। ফাইল চিত্র।
নরেন্দ্র মোদীকে পড়া-না-পারা ছাত্রের জায়গায় দাঁড় করিয়ে বকুনি দিতে পারেন হাতে-গোণা যে ক’জন মানুষ, তাঁদের এক জন প্রণব বর্ধন। সর্বদা হাসিখুশি এই অর্থনীতির অধ্যাপকের প্রতি প্রশ্ন ছিল, ‘চাষিদের দুর্দশা ঘোচাতে কেন্দ্র কী করবে মনে হয়?’ উত্তর এল, ‘আমি তো জানিই না, কেন্দ্রও জানে বলে মনে হয় না।’
সত্যিই দিশাহীন দশা কেন্দ্রের। বাজেটে গ্রামীণ অর্থনীতির স্টিয়ারিং ডান দিকে ঘুরবে নাকি বাঁ দিকে, তা-ই নিয়ে জল্পনা চলছে। সরকারি নীতির আন্দাজ করতে চেয়ে থাকতে হচ্ছে বাজেটের দিকে। এটাই মোদী সরকারের ব্যর্থতার চেহারাটা অনেকটা দেখিয়ে দেয়। কারণ, কৃষিনীতি বলে বস্তুত এই সরকারের কিছু নেই। যা আছে, তা হল টার্গেট। ক্ষমতায় আসার আগে বিজেপির ঘোষিত টার্গেট ছিল সরকারি সহায়ক মূল্য বাড়ানো। ২০১৪ সালের সাধারণ নির্বাচনের আগে বিজেপির প্রতিশ্রুতি ছিল, ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য ধার্য করা হবে উৎপাদন খরচের চাইতে পঞ্চাশ শতাংশ বেশি।
কথা রাখেনি সরকার। সহায়ক মূল্য বাড়েনি, বাজারের উপর নিয়ন্ত্রণও রাখতে পারেনি। গত বছর বৃষ্টি হয়েছে, উৎপাদনও ভাল হয়েছে, তবু ধান ছাড়া অন্য সব খরিফ ফসল, অর্থাৎ গ্রীষ্মের ফসলে (যেমন অড়হড়, কলাই, ভুট্টা, সয়াবিন, চিনেবাদাম, তুলো) লোকসান করেছে চাষি। ২০১৬ সালের তুলনায় ২০১৭ সালে পড়ে গিয়েছে সব ফসলের দাম।
বরফ-ঢাকা দাভোসে মোদী যখন বিশ্বকে স্বপ্ন দেখাচ্ছেন এক উন্নত ভারতের, চাষি তখন অনুন্নয়নের আবর্তে পড়ে ঘুরপাক খাচ্ছে। গত সাড়ে তিন বছরে কৃষি ক্ষেত্রে বৃদ্ধি কমেছে। বর্তমানে তা দুই শতাংশেরও কম, যা গত তিন দশকে সর্বনিম্ন। নরসিংহ রাও সরকার, বাজপেয়ী সরকার, মনমোহন সিংহের নেতৃত্বে দু’টি ইউপিএ সরকার, কৃষির বৃদ্ধিতে সবার পিছনে নরেন্দ্র মোদী। নীতি আয়োগের কৃষি বিশেষজ্ঞ রমেশ চাঁদ হিসেব কষে দেখিয়েছেন, গত পাঁচ বছরে চাষির প্রকৃত আয় (রিয়াল ইনকাম) প্রতি বছর কমেছে ১.৩ শতাংশ।
এখন সরকারের নতুন টার্গেট, ২০২২ সালের মধ্যে চাষির রোজগার দ্বিগুণ করো। স্লোগান হিসেবে অতি উত্তম। কিন্তু তার মানে কী দাঁড়ায়? সরকারেরই নিয়োজিত অশোক দলওয়াই কমিটি বলছে, ওই লক্ষ্যে পৌঁছতে হলে প্রতি বছর চাষির রোজগার বাড়াতে হবে প্রায় সাড়ে দশ শতাংশ হারে। এখন যে হার আড়াই শতাংশের আশেপাশে। এমন হাইজাম্প কি সম্ভব?
সন্দেহ গাঢ় হয় যখন নজরে পড়ে, এখনও অবধি কৃষিতে মোদীর তিনটে ফ্ল্যাগশিপ স্কিম-এর তিনটিরই করুণ দশা। ২০১৯ সালের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী কৃষি সিঁচাই যোজনার অধীনে ৯৯টি বৃহৎ সেচ প্রকল্প সম্পূর্ণ হওয়ার কথা ছিল। এখনও অবধি হয়েছে মাত্র দশটা, তারও অনেকগুলোর খেত অবধি ক্যানাল টানার কাজ শেষ হয়নি।
ফসল বিমা যোজনার অধীনে চাষির সংখ্যা দ্রুত বেড়েছে ঠিকই। বিমার আওতায় এখন চল্লিশ শতাংশ চাষি, যা ইউপিএ আমলের চাইতে দ্বিগুণেরও বেশি। কিন্তু তাদের মধ্যে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষির ভাগ সামান্যই, বলছেন কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল। আর ক্ষতিগ্রস্ত চাষিকে টাকা দেওয়াতে বিলম্ব আর দুর্নীতি তথৈবচ। অন্তত ক্ষতিপূরণ পাওয়ার আশ্বাস চাষির আত্মহত্যা যে কমাতে পারেনি, গত দু’বছরে তা স্পষ্ট।
ইলেকট্রনিক ন্যাশনাল এগ্রিকালচারাল মার্কেট বা ‘ই-ন্যাম’ চালু করে চাষির জন্য সরাসরি বিপণনের ব্যবস্থা হবে, বলেছিলেন মোদী। বহু বাদ্যি বেজেছে, দেশের ১৩ কোটি চাষির আধ কোটিও ওই ব্যবস্থায় যুক্ত হননি। ইন্টারনেট সংযোগের সমস্যা, ফসল ঝাড়াই-বাছাই, তার গ্রেডিং-এর ব্যবস্থার অভাব, এমন নানা সমস্যায় ফেঁসে রয়েছে বৈদ্যুতিন জাতীয় কৃষি বাজার। ফলে বাজার ব্যবসায়ীর দখলে, চাষি আজও কোণঠাসা।
এখন কৃষি বিশেষজ্ঞরা মোটামুটি একমত। তাঁরা বলছেন, চটজলদি দাওয়াইয়ে কাজ হবে না। ভারতে দীর্ঘ দিন কৃষি ক্ষেত্রে কোনও সংস্কার হয়নি। চাষের জন্য জমি ঠিকা দেওয়া, ফসল বিক্রির জন্য চাষির সঙ্গে বড় কোম্পানি চুক্তির আইন তৈরি করা, বদল করা হয়নি। সেই সঙ্গে ফসল উৎপাদন, পরিবহণ, সংরক্ষণের পরিকাঠামোয় তেমন কোনও উন্নতি আনা হয়নি। চাষির সুবিধের জন্য যে সব সরকারি সুযোগ-সুবিধে দেওয়া হয়, তা ছোট চাষির কাজে লাগছে সামান্যই, তা বুঝেও তার অদল-বদল হয়নি। অব্যবস্থাই এখন অচলাবস্থায় পরিণত হয়েছে। তার ফল ফলেছে মোদী জমানায়। ভাল বৃষ্টি, ভাল উৎপাদন হলেও চাষি ফসলের দাম পান না।
কী করলে চাষির রোজগার বাড়তে পারে, তার উত্তর খুঁজতে গিয়ে অশোক দলওয়াই কমিটি চারটি ক্ষেত্রে সংস্কারের কথা বলেছে।
প্রথমটি হল জমি। ভাগ হতে হতে চাষের জমি এখন অতি-ক্ষুদ্র, ভারতে ৮৬ শতাংশ জমির আয়তন দুই একর (মোটামুটি ছয় বিঘা) বা তারও কম। এত ছোট জমিতে আধুনিক প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে উৎপাদন অসম্ভব। যাঁরা কৃষির উপর নির্ভরশীল,তাঁদের অন্যের জমি ঠিকা নিতে হয়। কিন্তু আজও তা বেআইনি। ঠিকাচাষি মালিক হয়ে বসবে, এই ভয়ে জমির মালিক জমি ফেলে রাখেন, নইলে দেন কেবল মুখের চুক্তিতে। ছোট চাষির তাতে ঝুঁকি বাড়ে, সে ঋণ-বিমা পায় না। কেন্দ্র একটা আইনের খসড়া করেছে ঠিকাচাষি ও জমির মালিক উভয়ের সুরক্ষা নিশ্চিত করে।
সেই রকম, চাষিরা যাতে সরাসরি বড় বড় কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করতে পারে, যাতে ফসল ওঠার পর বাজার ধরার ঝুঁকি অনেকটাই কমে যায়, তার জন্যও একটা খসড়া আইন হয়েছে। বাজেট বক্তৃতায় সরকার এই প্রস্তাবিত আইনের প্রসঙ্গে তোলে কি না, দেখা দরকার।
মনে রাখতে হবে, ঠিকাচাষের বৈধতা, আর চুক্তিচাষ, এই দু’টিরই চিরকাল বিরোধিতা করেছেন বামপন্থীরা। তাঁদের মতে, এগুলি ছোট চাষির স্বার্থের বিরোধী। কিন্তু সাবেকি ব্যবস্থাতেও তো ছোট চাষি সুরক্ষিত হচ্ছে না। সংসদে এই তর্ক ওঠা দরকার।
দ্বিতীয়ত, চাষির রোজগার বাড়াতে হলে তাকে বাজার ধরতে দিতে হবে, বলছে দলওয়াই কমিটি। এখন বাজারে একটা ফুলকপি, এক কিলোগ্রাম ডাল বা এক কুইন্টাল চালের যা দাম, চাষি পায় তার ১৫ থেকে ৪০ শতাংশ। চাষির ভাগ বাড়াতে হবে। সেই উদ্দেশ্যে প্রতিটি রাজ্যে একটাই ফসল ও গবাদি পশুর বাজার তৈরি করতে, এবং সব রাজ্যের বাজারকে জাতীয় ই-বাজারের সঙ্গে জুড়তে আইনের খসড়া করেছে কেন্দ্র। রাজ্যগুলো আইন না বদলালে কিছু হবে না। তবে বিজেপি এখন উনিশটি রাজ্যে ক্ষমতায়, সংস্কারের এই সুযোগ।
বিঘা-প্রতি ফসলের উৎপাদন বাড়ানো, এবং ফসল বৈচিত্র্য আনা (বেশি দামী, উন্নত মানের ফসলের চাষ), চাষির রোজগার বাড়ানোর জন্য এই দুই সংস্কার হল দলওয়াই কমিটির তৃতীয় ও চতুর্থ দাওয়াই।
এর প্রতিটির জন্যই মৌলিক সংস্কার প্রয়োজন, কেবল বাজেট বাড়িয়ে-কমিয়ে এর কোনওটা সম্ভব নয়। তবু এগুলির কোনটিকে সরকার প্রাধান্য দিচ্ছে, আদৌ দিচ্ছে কি না, তার ইঙ্গিত মিলতে পারে বাজেটে।
আরও পড়ুন: প্রধানমন্ত্রী চকোলেট খেতে চাইতেই পারেন, কিন্তু...
সম্প্রতি একটি গবেষণাপত্রে দেখা গিয়েছে, ছোট চাষি সংসার চালাতে ফসল বিক্রির চাইতে দিনমজুরি, খেতমজুরি, আর গরু-ছাগল বিক্রির টাকার উপর নির্ভর করে বেশি। কৃষিক্ষেত্রে বৃদ্ধির একটা বড় অংশও আসে গবাদি পশুর বাজার থেকে। গোরক্ষকদের হামলায় দেশে গবাদি পশুর বাজার মার খেয়ে গিয়েছে। দরিদ্র চাষির রোজগার নিশ্চিত করতে হলে তাদের সংযত করা চাই।
অন্য দিকে, ঋণ মকুবের পরিচিত পথে হাঁটলে রাজস্বের বিপুল ক্ষয় হতে বাধ্য। ছোট চাষির লাভও হবে সামান্যই। তবে গ্রামীণ অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে গ্রামের মানুষের রোজগার বাড়ানোর পথ নিতে পারে সরকার। একশো দিনের কাজ, বা গ্রামীণ পরিকাঠামো নির্মাণের কাজে সরকারি বরাদ্দ বাড়ানো হতে পারে। কিন্তু তাতে দীর্ঘমেয়াদি সমাধান মিলবে না। বিশেষত একশো দিনের কাজ যে গ্রামে স্থায়ী সম্পদ বাড়াতে পারছে না, তা এত দিনে স্পষ্ট।
ভারতে ৪৭ শতাংশ মানুষের জীবিকা কৃষির উপর নির্ভরশীল। চাষির উন্নয়ন না হলে দেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়। গোটা বিশ্বেই দেখা গিয়েছে, কৃষিক্ষেত্রে বৃদ্ধি যতটা দারিদ্র কমাতে পারে, অকৃষি ক্ষেত্রে তার সমান বৃদ্ধি দারিদ্রকে ততটা কমাতে পারে না। কৃষি তথা গ্রামীণ অর্থনীতি ঘুরে না দাঁড়ালে ভারতে সম্পদের অসাম্য আরও বাড়বে, হিংসা ও অস্থিরতা সমাজকে আরও দুর্বল করবে। বাজেটে চাষির কী হল, সে প্রশ্ন তাই সবার কাছেই এ বার মস্ত বড় হয়ে উঠেছে।