১৯৫৪ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি শিলচরে তাঁর জন্ম। কাছাড় হাই স্কুল থেকে ১৯৭১ সালে মাধ্যমিক পাশ করেন। পরে অরুণাচলপ্রদেশে অডিট ও পেনশন দফতরে চাকরি পেয়ে যান। চাকরি জীবন কাটান সেখানকার নাহারলাগুন এলাকায়। অবসর নিয়ে বাড়ি করেন পশ্চিমবঙ্গে, উত্তর ২৪ পরগনায়। তাঁকেই এ বার কলকাতা-শিলচর ছুটোছুটি করে ট্রাইব্যুনালে দাঁড়িয়ে প্রমাণ করতে হল, তিনি বাংলাদেশি নন। বিচারক এম ইউ লস্কর সমস্ত নথিপত্র দেখে সন্দেহের কোনও যুক্তি নেই বলে রায় দিয়েছেন, তবু আক্ষেপ যাচ্ছে না ষাটোর্ধ্ব সোমেশ দেবরায়ের। নিজেকে বার বার একটাই প্রশ্ন করে চলেছেন, অসমে জন্ম বলেই কি এমন ভোগান্তির শিকার হতে হল!
সন্দেহভাজন ভোটারের নামে অসমের বাঙালিদের হেনস্থার অভিযোগ যে অমূলক নয়, এই মামলায় তা আরও একবার সামনে এল। সরকারি কর্মচারীরা কতটা দায়সারা হয়ে এক জন নাগরিককে রাষ্ট্রহীন করার সুপারিশ করতে পারেন, স্পষ্ট হল তা-ও। সোমেশবাবুর বিরুদ্ধে বাংলাদেশি বলে সন্দেহ প্রকাশ করেই ক্ষান্ত হননি সংশ্লিষ্ট ইলেকটোরাল রেজিস্ট্রেশন অফিসার এম সি চক্রবর্তী। সঙ্গে জুড়ে দিয়েছেন সরেজমিনে খতিয়ে দেখার রিপোর্টও। তাতে লেখা, সোমেশবাবু একজন ব্যবসায়ী। তাঁর উচ্চতা ৫ ফুট ৪ ইঞ্চি। ওই রিপোর্টে পুলিশ সুপারকে আরও জানানো হয়, অভিযুক্ত ভারতীয় নাগরিকত্বের কোনও প্রমাণপত্র তাঁকে দেখাতে পারেননি।
অরুণাচলপ্রদেশের সরকারি কর্মচারী সোমেশবাবুকে ব্যবসায়ী লেখার মধ্যেই স্পষ্ট, ওই অফিসার তাঁর সম্পর্কে খোঁজখবর নেওয়ারও প্রয়োজন বোধ করেননি। একেবারে মনগড়া ভাবে সোমেশবাবুর বিরুদ্ধে সন্দেহভাজন বাংলাদেশি বলে রিপোর্ট করেছেন। সোমেশবাবুর ভাই বরাক উপত্যকার বিশিষ্ট নাট্যকার ও নির্দেশক শেখর দেবরায় বলেন, ‘‘কোনও ভারতীয় নাগরিকের শখ হয় নাকি যে, কাগজপত্র না দেখিয়ে সারা জীবন ডিটেনশন ক্যাম্পে বন্দি থাকবে! ভাগ্যিস, দাদা তিন রাজ্যে জিনিসপত্র টানাটানি করতে গিয়ে স্কুল-কলেজের কাগজগুলিকে অপ্রয়োজনীয় ভেবে ফেলে দেননি। চাকরি থেকে অবসরের পর সে-সবের আর কী প্রয়োজন ভাবলেই মুশকিলে পড়তে হতো তাঁকে।’’ শেখরবাবুর কথায়, ‘‘কাগজপত্র ঠিকঠাক না রাখায় কত প্রকৃত ভারতীয়কে যে জেলের ঘানি টানতে হচ্ছে!’’
প্রসঙ্গত, সোমেশবাবুর বিরুদ্ধে বিদেশি বলে অভিযোগ করা হয় ১৯৯৭ সালে। ২০১১ সালে তা ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালে নথিভুক্ত হয়। ট্রাইব্যুনাল তাঁকে ডেকে পাঠায় আরও ৫ বছর পর। নাগরিক অধিকার রক্ষা সমিতির (সিআরপিসি)-র কেন্দ্রীয় কমিটির প্রধান সম্পাদক সাধন পুরকায়স্থ বলেন, ‘‘এ সবের একমাত্র উদ্দেশ্য, বাঙালিরা যেন অসম ছেড়ে পালায়। আত্মসম্মান বোধ থাকা মানুষেরা এ ভাবে থাকতে পারেন না।’’ কিন্তু সোমেশবাবু রাজ্য ছেড়েও রেহাই পেলেন না। আইনের প্যাঁচে বহু ভারতীয় ডিটেনশনে ক্যাম্পে বন্দি রয়েছেন বলে জানান সাধনবাবু।